বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
75

দেই। এটা ছিল একটি ডিলেয়িং পজিশন। এ পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয় যাতে শত্রুদের অগ্রসরে আরো বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনার সম্ভবত অগ্রসরের রাস্তার পশ্চিম এবং পূর্ব পার্শ্বে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা বেশ কতগুলো উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে শক্ত এবং মজবুত বাঙ্কার তৈরী করি এবং তাতে হালকা মেশিনগান এবং মেশিনগান লাগিয়ে দেই। এ ছিল একরকমের ফাঁদ যাতে একবার অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হলে দু'পাশের গুলিতে শত্রুসেনারা ফিরে যেতে না পারে। এসব বাঙ্কার এমনভাবে লুকোনো ছিল যে সম্মুখ থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না।

 ৭ই জুনের সকাল। আমরা জানতে পারলাম শত্রুসেনারা ফেনী থেকে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১০টার দিকে জন্দুয়ার আশেপাশে শত্রুসেনারা এসে জমা হতে লাগল এবং প্রথমবারের মত আমাদের পজিশনের উপর গোলাগুলি চালাতে লাগল। আমার নির্দেশ ছিল যে শত্রুদের এই গোলাগুলির কোন জবাব যেন না দেয়া হয়। শত্রুসেনারা বন্দুয়া সেতুর উপর একটা বাঁশের পুল নির্মাণ করে যেমনি পার হওয়ার চেষ্টা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের বীর সৈনিকরা তাদের উপর গুলি চালায়। এতে প্রথম সারিতে যেসব শত্রুসেনা সেতু অতিক্রম করার চেষ্টা করে তারা সবাই গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ পর্যায়ে শত্রুসেনাদের অন্তত ৪০/৫০ জন লোক হতাহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা পিছে হটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার প্রবল গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। আমাদের ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকরা শত্রুদের আরো বহুসংখ্যক লোক হতাহত করে বীরত্বের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে কিন্তু আক্রমণ যখন আরও তীব্ররূপ ধারণ করে ডিলেয়িং পজিশনকে তারা পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে পিছু হটে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় আরো প্রবল বেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ছিলোনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানে এসে তারা নদী পার হওয়ার সকল প্রস্তুতি নেয়। আমাদের প্রধান ঘাঁটি থেকে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর নামক গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। নদী পার হয়ে আমাদের আক্রমণ করার জন্য শত্রুরা সকল প্রস্তুতি নিতে থাকে। নদী পার হবার পূর্ব মুহূর্তে কামানের সাহায্যে আমাদের ঘাঁটির উপর তারাপ প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে। তারা বৃষ্টির মত গোলা আমাদের অবস্থানের উপর ছুড়ছিল। এ আকস্মিক আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্য আমরা ভালভাবেই বুঝতে পারছিলাম। এই সুযোগে পাকসেনারা নদী পার হবার জন্য নৌকা এবং বাঁশের পুলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। যদিও আমরা শত্রুদের কামানের গোলায় যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিলাম তবুও মানসিক দিক দিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল বিপুল। ওদের বেশসংখ্যক সৈন্য নদী পার হয়ে আমাদের অবস্থানের ২০০/৩০০ গজ ভিতরে চলে আসে এবং কিছুসংখ্যক তখনও নদী পার হচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়ে আমাদের মর্টার এবং মেশিনগান গর্জে ওঠে। আমাদের এ অকস্মাৎ পাল্টা উত্তরে শত্রুসেনারা অনেক হতাহত হতে থাকে। তবুও তারা বাধাবিপত্তি ডিঙ্গিয়ে প্রবল বেগে অগ্রসর হতে থাকে। আর আমাদের সৈনিকরাও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। তবুও তারা নিঃসহায় অবস্থাতে ও দক্ষতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ হয়ত ওদের সহায় ছিলেন না। এ সময়ে তারা আমাদের সামনের মাইন ফিল্ডের মুখে এসে পড়ল। তাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে আরম্ভ করল। আমাদের চোখের সামনে অনেক শত্রুসেনা তুলোর মত উড়ে যেতে লাগল। আমাদের গোপনে অবস্থিত পাশের মেশিনগানগুলির বৃষ্টির মত গুলি ও মাইনের আঘাত তাদের মধ্যে একটা ভয়াভহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। শুধু কয়েকজন শত্রু এসব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের কয়েকটি অগ্রবর্তী বাঙ্কারেস সামনে পর্যন্ত পৌছায়, কিন্তু আমাদের সৈনিকরা গ্রেনেড হাতে তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং তারা সেখানেই আমাদের গ্রেনেডের মুখে ধ্বংস হয়। এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে শত্রুনারা আর সামনে এগোতে পায়নি। যারা পিছনে ছিল তারাও সংকটজনক অবস্থা এবং ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পিছনে দিকে পলায়ন করতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে আমাদের সৈনিকরাও উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে এবং আরো প্রবল গতিতে তাদের গুলি করে মারতে থাকে। আমাদের মর্টারও পশ্চাদপসরণরত শত্রুদের ওপর অনবরত আক্রমণ চালিয়ে তাদের হতাহত করতে থাকে। আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে ওদের খুব কম সৈন্য ছিলোনিয়া নদীর অপর পারে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। এ সময়ে আমাদের উপর শত্রুসেনারা অনবরত কামানের গোলা চালিয়ে যাচ্ছিল