পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
81

তবুও তারা অগ্রসর হতে থাকে। তারা তখন আমাদের অবস্থান থেকে ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়ে, ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল তাদের উপর অকস্মাৎ গুলিবর্ষন শুরু করে। শত্রুরা আমাদের অবস্থান এত সামনে আছে তা জানত না। চতুর্দিকে গুলিতে তাদের দুটি কোম্পানী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং শত্রুসেনারা চারিদিকে ছুটাছুটি করতে থাকে। এতে তাদের নিহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ৩১ বেলুচ কিছুক্ষন পর তাদের আক্রমন পরিত্যাগ করে। কিন্তু এক ঘণ্টা পরে পাকসেনারা শালদা নদীর দক্ষিন তীরের সাথে আমাদের অবস্থানের ডান পাশ দিয়ে পিছনে আসার চেষ্টা করে। তারা যে এরুপ একটা কিছু করতে পারে ক্যাপ্টেন গাফ্ফার তা পূর্বেই অনুমান করেছিল। এ জন্য ক্যাপ্টেন গাফফার তৈরীও ছিল। সুবেদার ওহাবের অধীন একটি কোম্পান কে সে আগে থেকেই শালদা নদীর তীরে এ্যামবুশ পজিশনে রেখেছিল। শত্রুরা অজ্ঞাতে এ এ্যামবুশ পজিশনটির ফাদে পড়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তারা অবস্থানটির উপর প্রবল আক্রমণ স্থগিত রেখে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদলও সুবেদার ওহাবের সেনাদল পশ্চাৎগামী শত্রুদের পিছনে ধাওয়া করে। এ সময় অনেক আহতও নিহত হয়। যুদ্ধের শেষে সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে খুজে আমরা অন্তত ১২০টা মৃতদেহ খুজে পাই এবং আরো অনেক মৃতদেহ যেগুলি পানিতে ছিল, খুজে পাওয়া যায়না। এ যুদ্ধের ফলাফল আমার পক্ষে অনেক লাভজনক ছিল। আমরা ৮টা মেশিনগান, ১৮টা হালকা মেশিনগান প্রায় দেড়শ (১৫০) রাইফেল, ২টা রকেট লাঞ্চার, ২টা মর্টার অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। আরো অনেক অস্ত্রশস্ত্র যেগুলি পানিতে ছিল, সেগুলি খুজে পাওয়া যায়নি। মৃতদেহগুলির মধ্যে ১ জন ক্যাপ্টেন, ১ জন লেফটেন্যাণ্ট এবং আরো কয়েকজন জুনিয়র কমিশণ্ড সনাক্ত করা হয়। শত্রুরা এ সময় বৃষ্টি এবং বন্যার জন্য আমাদের হাতে বেশ নাজেহাল হচ্ছিল এবং তাদেরকে বাধ্য হয়ে গতিবিধি শুধু রাস্তায় সীমিত রাখতে হচ্ছিল। কিন্তু আমরা শত্রুদের এ দুর্বলতা সম্পুর্নভাবে কাজে লাগাতে পারছিলাম না যেহেতু তখন আমরা অস্ত্রশস্ত্রের দিকে দুর্বল ছিলাম-যদিও ইতিমধ্যে আমাদের বেশ সংখ্যক লোক ট্রেনিং পেয়ে প্রস্তুত ছিল। অস্ত্রের অভাবে এসব ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকদের আমরা ভেতরে পাঠাতে পারছিলামনা। শত্রুরা আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে তাদের গতিবিধি আরো বাড়াবার জন্য জলযানের যোগাড় করতে লাগল বাংলাদেশের যত লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট ছিল, সেগুলি দখল করে মেশিনগান ফিট করে এগুলিকে গানবোট হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল।

 আমাদের কাছে খবর আসে যে, শত্রুরা 'পাক বে' কোম্পানীতে তিনশত ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। নারায়নগঞ্জের 'পাক বে' ডাকইয়ার্ডে এসব স্পীডবোট তৈরীর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এই বে' কোম্পানীর একজন অফিসারের ভাই আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল। সে এসে খবর দেয় যে এই স্পীডবোটে লাগাবার জন্য তিনশ ইঞ্জিন সদ্য আনা হয়েছে এবং সেগুলি পাক বে'র গুদামে মওজুত রাখা আছে আমি তৎক্ষনাৎ সেই ছেলেটিকে আরো দশজন গেরিলা মনোনয়ন করার নির্দেশ দিই এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট প্রস্তুত হয়ে গেলে শত্রুদের গতিবিধি অনেক গুনে বেড়ে যাবে, এই বর্ষার মওসুমে শত্র সেনারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছতে পারবে। তখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূর গ্রামের গোপন অবস্থানগুলি অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে পড়বে। সে জন্য এই মেশিনগুলিকে এখনই ধ্বংস করে দিতে হবে। নির্দেশমত মনোনীত দলটিকে প্রশিক্ষনের পর নারায়নগঞ্জে পাঠিয়ে দিই। নারায়নগঞ্জে এসে তারা প্রথম 'পাক বে'র গুদামটি রেকি (অনুসন্ধান) করে এবং জানতে পারে যে, দুজন পুলিশ এবং দুজন চৌকিদার যে গুদামটিতে মেশিনগুলো রাখা আছে সেখানে পাহারা দিচ্ছে। সেদিন সন্ধায় আমার দলটি অতর্কিতে পুলিশদের নিরস্ত্র করে ফেলে এবং পুলিশ ও চৌকিদারদের একটি কামরায় বন্ধ করে গুদামের তালা ভেঙ্গে গুদামে প্রবেশ করে। গুদামের ভিতর ডিজেল এবং পেট্রোল ছিল। সেগুলি সব মেশিনের উপর ঢেলে দেয় এবং যেসব ফাইবার গ্লাস নৌকা প্রস্তুত ছিল তাতেও ঢেলে দেয়। এরপর অগ্নিসংযোগ করে বেরিয়ে আসে। কয়েক সেকেণ্ডের ভিতর সমস্ত মেশিনে এবং ফাইবার গ্লাস নৌকাগুলিতে আগুন লেগে যায় এবং বিস্ফোরন ঘটে। এই বিস্ফোরণে শত্রুদের সমস্ত মেশিন এবং ৩০০ নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়।