বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
105

পড়ে যায়। পাকসেনাদের প্লাটুনটি যখন পুরোপুরি আমাদের এ্যামবুশ পার্টির সম্মুখে এসে যায় তখন আমাদের দলটি হালকা মেশিনগান এবং অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। পাকসেনারা অতর্কিত এই আক্রমণে হকচকিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এই এ্যামবুশে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং তিনজন আহত হয়। আমাদের দলটি পাকসেনাদের একটি এমজিআইএ মেশিনগান ও কয়েকটি জি-৩ রাইফেল দখল করে।

 পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল জগন্নাথ দিঘীতে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি মাঝে মাঝে নিকটবর্তী চিয়ারা গ্রামে রাত্রিতে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতো। এই খবর আমরা পেয়ে যাই। ২৩শে আগস্ট মেজর জাফর ইমাম এই দলটিকে আক্রমণ করার জন্য দুটি প্লাটুন নিয়ে চিয়ারা গ্রামের নিকট পাকসেনাদের অপেক্ষায় অবস্থান করে। রাত সাড়ে ১২টায় জগন্নাথ দিঘী পাক অবস্থানের উপর মুক্তিযোদ্ধা একটি দল আক্রমণ চালায়। একই সঙ্গে চিয়ারা গ্রামে অবস্থিত পাকসেনাদের উপর মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের ফলে চিয়ারা গ্রামে অবস্থিত পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ২৪ জন পাকসেনা আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। কিছু শত্রুসেনা আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জগন্নাথ দিঘীতেও চারটি বাঙ্কার আমাদের মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। নয়ানপুর রেল স্টেশনে পাকসেনাদের উপর ৪র্থ বেঙ্গলের 'এ' কোম্পানী এবং ‘সি' কোম্পানী তাদের চাপ আরো জোরদার করে। ২৩শে আগস্ট সকাল ১১টায় উক্ত কোম্পানী দুটি মিলিতভাবে স্টেশনের উত্তর এবং দক্ষিণ দিক থেকে মর্টার ও ১০৬-রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে পাক অবস্থানের উপ সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ১০৬- রিকয়েললেস রাইফেলের আঘাতে পাকিস্তানীদের বেশ কটি শক্ত বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয়। স্টেশনের কিছু দূরে একটি গুদাম ছিল। তার ভিতরেও পাকসেনারা বাঙ্কার বানিয়েছিল। গুদামটিতেও রকেট মারা হয়। ফলে গুদামে আগুন ধরে যায়। রকেটিং-এর পর মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণ এত সফল হয়েছিল যে, শত্রু অবস্থান থেকে ভীতসন্ত্রস্ত আর্তনাদ এবং চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণের জবাব দেবার সুযোগ পায়নি। শত্রুদের প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা সে সময়ে জানা যায়নি। পরে আমরা গ্রামবানী সূত্রে খবর পেয়েছি যে, আক্রমণে পাকসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হয়েছে।

 নোয়াখালী এবং বেলুনিয়াতে আমাদের সৈনিকরা এবং গেরিলা দল পাকসেনাদের নাজেহাল করে তুলেছিল। ২২শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি দল সোনাগাজীর দিকে ট্রাকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের একটি দল রাস্তায় এণ্টি-ট্যাঙ্ক মাইন পেতে ভোর ৫টায় পাকসেনাদে দলটিকে এ্যামবুশ করে। মাইনের আঘাতে পাকসেনাদের তিনটি প্রাক ধ্বংস হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। এ ছাড়াও এ্যামবুশ পার্টির গুলিতে প্রায় ৪০ জন পাকসেনা এবং রাজাকার হতাহত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ফিরে আসে। এই ঘটনার দুদিন পর চৌদ্দগ্রাম এবং লাকসাম সড়কের উপর আমাদের গেরিলারা মাইন পুঁতে রাখে। পাকসেনাদের একটি ডজ গাড়ি মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। গাড়িতে অবস্থানরত একজন অফিসার এবং একজন পাকসেনা নিহত হয়। একই সময় ফেনী থেক একটি ট্রাক পাকসেনাসহ চৌদ্দগ্রামের দিকে আসছিল। আমাদের একজন গেরিলা ট্রাকের ভিতর একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। প্রায় ২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অপর পক্ষে পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার শাহজাহান শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনার হাতে ধরা পড়ে। গেরিলারা ফেনীর কাছে গুমদণ্ডী রেলওয়ে লাইন ডিমোলিশন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ফেনী এবং এবং কুমিল্লার মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ সামরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২১শে আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টায় আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি পাকসেনাদের একটি দলকে কুমিল্লার উত্তরে গাজীপুর রেলওয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে দেখে। আমাদের পেট্রোল পার্টিটি পুলের নিকট এ্যামবুশ পেতে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা এ্যামবুশ অবস্থানটির মধ্যে এসে যায় এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণে একজন লেফটেন্যাণ্ট সহ ছ'জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্ট পাকসেনারা পালিয়ে বাঁচে। বহু অস্ত্রশস্ত্র এবং ম্যাপ আমাদের দখলে আসে।