পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
108

থাকে। নয়ানপুর থেকে আরো দুটি নৌকায় পাকসেনারা তাদের দলটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হয়। প্রথম নৌকাটি আমাদের গুলিতে ডুবে যায় এবং ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্য উপায় না দেখে দ্বিতীয় নৌকার সৈন্যরা তীরে নেমে পালিয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা সমস্ত দিন এবং রাত হরিমঙ্গল, শশীদল এবং সেনের বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আমাদের সেনের বাজার এবং গৌরাঙ্গল অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরের দিন সকাল ৯টায় ৩০ জন পাকসেনা দুটি নৌকায় সেনের বাজার অবস্থানের দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের মেশিনগানের গুলিতে দুটি নৌকাই ডুবে যায় এবং সকল পাকসেনাই নদীতে ডুবে মারা যায়।

 আগস্ট মাসের শেষে ঢাকাতে আমাদের গেরিলাদের শক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তারা পাকসেনাদের ঢাকায় ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। পাকসেনারা প্রায়ই রাতে ঢাকা শহরে ট্রাকে করে টহল দিতে বেরুতো। টহল দেয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে শহরবাসীদের উপর জঘন্য অত্যাচার চালাতো। পাকসেনাদের রাতের এই তৎপরতা সীমিত করার জন্য আমাদের গেরিলারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেসব রাস্তায় সাধারণত পাকসেনারা টহল দিতে গেরিলারা সেসব রাস্তার ওপর বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য রাখে। কোন রাস্তায় কতটার সময় কতগুলো গাড়ি কত গতিতে চলে, কত ব্যবধান দুই গাড়ির ভিতর বিরাজ করে প্রভৃতি তারা সংবাদ সংগ্রহ করে। ২৭শে আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় গ্রীন রোডের (স্টাফ কোয়ার্টারের বিপরীত দিকে) কতগুলো নির্মাণাধীন দোকানের ছাদে আমাদের গেরিলাদল এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। গেরিলারা রাস্তার উপর গাড়িবিধ্বংসী মাইন পেতে রাখে। এরপর এ্যামবুশ পার্টি পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় পাকসেনাদের ৪/৫টি বেডফোর্ড গাড়ী এবং জীপ তেজগাঁর দিক থেকে গ্রীন রোড হয়ে অগ্রসর হয়। প্রথম গাড়ীটি যখন এ্যামবুশ সাইট-এর শেষপ্রান্তে পৌঁছে তখন একটি মাইন-এর আঘাতে গাড়ীটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় গাড়ীটির চালক এই অবস্থা দেখে হকচকিয়ে পাশ কাটতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দালানের সঙ্গে ধাক্কা মারে, ফলে এই গাড়ীটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পেছনে পেছনে পাকসেনাদের আরেকটি জীপ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে মাইনের আঘাতে সেটিও উল্টে যায়। যেসব পাকসেনা ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ীগুলোতে অক্ষত অবস্থায় ছিল তারা গাড়ী থেকে বেরুবার চেষ্টা করে এবং গুলীবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের এ্যামবুশ পার্টির গেরিলারা ছাদ থেকে তাদের উপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায় এবং গুলি ছুড়তে থাকে। এর ফলে অধিকাংশ পাকসেনা হতাহত হয়। পেছন থেকে আরো একটি গাড়িতে পাকসেনারা ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। এবং গাড়ী থেকে নেমে আমাদের গেরিলাদের উপর আক্রমণ চালাবার চেষ্টা করে। আমাদের গেরিলারাও তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে তখন কোন উপায় না দেখে তারা ক্যাণ্টমেণ্টের দিকে পালিয়ে যায়। গোলাগুলির শব্দে স্থানীয় জনসাধারণ তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারা ২৪ জন পাকসেনার মৃতদেহ ও ৪১ জনকে আহত অবস্থায় এবং দুটি বিধ্বস্ত ট্রাক এবং একটি জীপ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। আমাদের পক্ষে দুজন সামান্য আহত হয়। আমাদের গেরিলারা কিছুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রীন রোডের পিছনে দিকের নিচু জায়গা দিয়ে নিরাপদে চলে আসতে সক্ষম হয়। পরের দিন এউ খণ্ডযুদ্ধ এবং পাকিস্তানীদের দুরবস্থার কাহিনী হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে জানতে পারে। এই সংবাদ সমস্ত ঢাকায় মুহূতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঢাকা শহরের মুক্তিকামী জনগণের মনে আশার সঞ্চার হয়। দুদিন পরে ঢাকার গেরিলারা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে এবং আরো কয়েকটি কলেজে আক্রমণ চালায়। তারা পরীক্ষার খাতাপত্র জ্বালিয়ে দয়ে। টঙ্গী এবং জয়দেবপুরের মাঝে দুটি বিদ্যুতের পাইলনও তারা উড়িয়ে দেয়। ২রা সেপ্টেম্বর রাতে পাকিস্তানীদের একটি জীপ যখন গ্রীন রোড দিয়ে যাচ্ছিল তখন আমাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জীপটির ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চারজন পাকসেনাকে নিহত করে। গ্রেনেড নিক্ষেপে জীপটির আংশিক ক্ষতি হয়।

 এছাড়া ঢাকার গেরিলা দল পশ্চিম পাকিস্তানী একটি পুলিশের দলকে কলাবাগানের কাছে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দশজনকে নিহত করে। কালিগঞ্জ-ডেমরা এবং কালিগঞ্জ-টঙ্গীর মধ্যস্থিত বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের চারটি পাইলন উড়িয়ে দেয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দল রূপগঞ্জের নিকট নদীর পাড়ে পাকসেনাদের যাতায়াতের