পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
114

তাদের বেইস স্থাপন করে। এর পর একটি ছোট রেকি (অনুসন্ধানী) দল বিমান বন্দর ও ক্যাণ্টনমেণ্টের চতুর্দিকে ৩/৪ দিন অনুসন্ধান চালায়। এই সময় পাকসেনারা বিমান বন্দর এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের নিরাপত্তার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাঙ্কার তৈরী করে এবং টহল দিয়ে আমাদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। যেহেতু মর্টারের রকেট চার হাজার গজ দূরত্বের বেশী নিক্ষেপ করা যায় না এবং মর্টার ফায়ার করার সময় ফ্লাশ দেখে এবং মর্টার পজিশন থেকে শব্দ শুনে পাকিস্তানী টহলদারী সৈনিকরা এর অবস্থান খুঁজে বের করতে পারে সেহেতু অনুসন্ধান চালাবার পর আমাদের দলটি বাড্ডার নিকট থেকে ৯ই অক্টোবর রাত ১টা ৪০ মিনিটের সময় মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুর করে। ৬টি গোলা ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টের একটি লাইনের মধ্যে পড়ে। এতে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। কয়েকটি গোলা বিমান বন্দরে নিকটে পড়ে কিন্তু কোন এয়ারক্রাফট-এর ক্ষতি সাধিত হয়নি। আরো কয়েকটি গোলা পাক টোব্যাকো কোম্পানীর ফ্যাক্টোরীতে পড়ে। এতে ফ্যাক্টরীর বেশ ক্ষতি হয়। কয়েকটি গোলা মহাখালী হাসপাতালের নিকটে রাস্তায় পড়ে। এই অতর্কিত মর্টার আক্রমণের ফলে ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পরে আমাদের কাছে খবর পৌঁছে যে, পাকিস্তানীরা ভেবে ছিল মুক্তিবাহিনী ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গ ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টের সমস্ত পাকসেনারা চতুর্দিকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে- স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্যাংসহ গুলশান এবং ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় সমস্ত রাত পাগলের মত ছুটাছুটি করতে থাকে এবং সারারাত গোলাগুলি চালায়। আমাদের দলটি আরো কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনাদেরকে আরো ব্যতিব্যস্ত করে সেখান থেকে সরে পড়ে।

 ১১ই অক্টোবর দুপুর ১২টায় আমাদের গেরিলারা তিতাস গ্যাস পাইপ লাইন আবার বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়।

 পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল পিলখানাতে অবস্থান করছিল। পিলখানার পাশের রাস্তা দিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাকসেনাদের অনেক গাড়ি যাতায়াত করতো। আমাদের আজিমপুরের গেরিলা দল সেই রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখে। ১৬ই অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টায় পাকসেনাদের একটা জীপ এই রাস্তায় টহল দেবার সময় মাইনের আঘাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৪ পাকসেনা নিহত এবং দুজন গুরুতররুপে আহত হয়। এর একদিন পর দুজন পাক পুলিশ মিরপুর রোডে টহল দেবার সময় ধানমণ্ডির নিকট আমাদের গেরিলাদের হাতে নিহত হয়।

 ঢাকার শহরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা এবং পাকসেনাদের নাজুক অবস্থা বিদেশী সংবাদ সংস্থাগুলি থেকেও ব্যাপক প্রচার করা হয়। এছাড়া এসব খবর ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসি থেকেও প্রচারিত হয়। ফলে হানাদার অধিকৃত এলাকার জনগনের মনেও মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য সম্পর্কে নতুন আশার সৃষ্টি হয়।

 ৩০শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল শালদা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে সমবেত হয় এবং বিধ্বস্ত রেলওয়ে সেতুর উপর বাঙ্কার তৈরী করার প্রস্তুতি নেয়। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি তাদের উপর গুলি চালিয়ে বেশকিছু পাকসেনাকে হতাহত করে। পাকসেনারা পিছু হটে যায়। পরদিন সকাল আটটায় পাকসেনারা অগ্রসর হয়ে আবার বাঙ্কার তৈরী করার চেষ্টা করে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেক হতাহত হয়। এরপর পাকসেনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। পাকসেনাদের ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামানগুলি এরপর ৪র্থ বেঙ্গলের 'এ' কোম্পানীর অবস্থানের উপর ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এতে আমাদের একজন সৈনিক শহীদ এবং ২/৩জন আহত হয়। পাকসেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কোনাবন থেকে ক্যাপ্টেন গাফ্ফার ৪র্থ বেঙ্গলের 'সি' কোম্পানীকে চাঁদলাতে পাঠান। এই কোম্পানীটিও ৩০শে আগস্ট বিকাল ৪টায় পাকসেনাদের একটি দলের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৯জন পাকসেনা ও ২৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। সংর্ঘর্ষে অনেক পাকসেনা আহত হয়। পরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে একটি হালকা মেশিনগান, ৩টি রাইফেলসহ অনেক গোলাবারুদ আমাদের সৈনিকরা