পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
117

 আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের ওপর তাদের হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। পাকসেনাদের চাপও আমাদের ওপর থেকে ধীরে ধীরে কমে যায়। পাকসেনারা তাদের বিপর্যস্ত অবস্থানগুলো বাঁচানোর জন্য ভারী তোপের সাহায্যে আমাদের মন্দভাগ কোনাবন এবং শালদা নদীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। এতে আমাদের ২ জন নন-কমিশশু অফিসার ও ১ জন গোলন্দাজ বাহিনীর ও-পি শহীদ হয়। পাক সেনাদের একটি জঙ্গী বিমান ২৮শে সেপ্টেম্বর তাদের সেনাদের সাহায্যের জন্য দুপুর দুটো থেকে তিনটা পর্যন্ত আমাদের অবস্থানগুলোর ওপর ক্রমাগত আক্রমন চালায়। পাকসেনাদের অবস্থানগুলো আমাদের আক্রমণে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে আমরা বুঝতে পারি এবং তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে এই এলাকা থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্য ২৭ তারিখে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৮ তারিখ সাড়ে ১০টার সময় ৪র্থ বেঙ্গলের একটা শক্তিশালী দল উত্তর দিক থেকে কায়েমপুরের শত্রু অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ৪ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ১৫ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। আমাদের কিছুসংখ্যক যোদ্ধাও শহীদ এবং আহত হয়। আমাদের সৈন্যদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা তাদের কায়েমপুর ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের সৈন্যরা তাদের পরিত্যক্ত অবস্থান থেকে মেশিনগান, মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে নেয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে আমাদের সৈন্যরা এইসব অবস্থানগুলো থেকে শত্রুর প্রবল চাপের মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। ফলে শত্রুরা এইসব জায়গা দখল করে নেয়। এর এক সপ্তাহ পরেই আমরা পুনরায় পাল্টা আক্রমণ চালাই। এই পাল্টা আক্রমণের ফলে প্রায় ২০১ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়, ৭০টি বাঙ্কার ধ্বংস করা হয় এবং অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি সে তুলনায় ছিল অতি অল্প-১০ জন শহীদ এবং ৬ জন আহত হয়। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের দখলকৃত কায়েমপুরা, শ্রীপুর, মইনপুর, কামালপুর, লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি জায়গা পুনরুদ্ধার করে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত দাউসসহ মন্দভাগের পশ্চিমের বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করা হয়। এর ফলে পাকসেনাদের মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন এবং তার পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত আমাদের দখলে থাকা এলাকা পুনরুদ্ধারের সমস্ত আশা ও পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে পড়ে এবং তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

 কসবার পশ্চিমে টি. আলীর বাড়ির নিকট অবস্থিত পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর ওপর আমাদের সৈনিকরা ক্রমাগত চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছিলো। ২৮শে আগস্ট ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানী থেকে একটা প্লাটুন পাক অবস্থানের পিছনে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের কাছে খবর ছিল পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে নৌকার সাহায্যে সরবরাহ কাজ চালাচ্ছে। এই প্লাটুনটিকে পাকসেনাদের সরবরাহকারী নৌকাগুলো এ্যামবুশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্লাটুনটি ২৯ তারিখ সকালে পাকসেনাদের পেছনে জলপথের ওপরে এ্যামবুশ লাগিয়ে বসে থাকে। বেলা ২-৪০ মিঃ পাকসেনাদের দুটি নৌকা সেদিকে অগ্রসর হয়। এ্যামবুশের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈনিকরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড গোলাগুলির পর তাদের দু'টি নৌকাই ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে ৩০ জন পাকসেনাই নিহত হয়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ হয়। ৪র্থ বেঙ্গলের 'ডি' কোম্পানীর আরও দুটি প্লাটুন সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত লাটুমুড়া, তাজিশ্বর, ফতেহপুর, চারনল বগাবাড়ি প্রভৃতি স্থানে পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণ করে ৩৬ জন খানসেনা ও ১৭ রাজাকারকে নিহত ও আহত করে। পাকসেনারা এই এলাকায় আমাদের সৈনিকদের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে একটি শক্তিশালী দল তাজিশ্বর ও বগাবাড়ির দিকে ১১ই সেপ্টেম্বর অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটির অগ্রসরের খবর আমাদের কাছে আগেই পৌঁছে যায়। 'ডি' কোম্পানীর দুটি প্লাটুন বাগাবাড়ির নিকট পাকসেনাদের পথে এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। ১১ তারিখ সকাল ৬টার সময় অগ্রগামী পাকসেনা দলটি আমাদের এ্যামবুশের আওতায় পড়ে যায়। আমাদের সৈনিকরা তাদের অতর্কিত আক্রমণ করে। প্রবল আক্রমণের মুখে পাকসেনারা টিকতে না পেরে আবার পশ্চাদপসরণ করে। এই যুদ্ধের ফলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন আহত হয়। পাকসেনাদের এই এলাকায় বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদের সাহায্যের জন্য ১৩ তারিখে পাকসেনাদের পাঁচটি জঙ্গী বিমান বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের