পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
120

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেলুনিয়াতে পাকসেনারা তাদের তত্তপরতা আরো বাড়িয়ে তোলে। ৬ই সেপ্টেম্বর পাক সামরিক জান্তা নয়ানপুরের নিকট বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। ঐ দিন রাত প্রায় ৩টার সময় পাকসেনাদের দুটি প্লাটুন সেলোনিয়া নদী অতিক্রম করে। আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। পাকসেনাদের দলটি নৌকাযোগে যখন নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে তখন আমাদের অগ্রবর্তী দল তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছুসংখ্যক আহত হয়।অবশিষ্ট সৈন্যরা মর্টারের গোলার সহায়তায় পশ্চাদপসরণ করে। পরদিন বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের আরেকটি শক্তিশালী দল আরো পশ্চিমে মহুরীন্দী অতিক্রম করার চেষ্টা করে। এখানেও আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। গোলাগুলিতে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ১৫ জন নিহত এবং প্রায় ২০ জন আহত হয়। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং আমাদের অবস্থানগুলোর ওপর প্রচণ্ডভাবে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের সৈনিকরা টিকতে না পেরে অগ্রবর্তী অবস্থান পরিত্যাগ করে স্থায়ী অবস্থানে ফিরে আসে। পাকবাহিনী তাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত এই আক্রমণ চলতে থাকে। আমাদের বীর সৈনিকরা তাদের অবস্থান থেকে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনাদের আক্রমণকে দেড় ঘণ্টার যুদ্ধে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনাদের অনেক হতাহত হয় ও পরে আমাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে ছাত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পরশুরামের নিকট সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পরশুরামে মোতায়েন করে। ৯ই সেপ্টেম্বর আমাদের খবর সংগ্রহকারী লোকেরা জানতে পারে যে পাকসেনারা বেশ কয়েকটি ১০৫ এর এমএম কামানসহ সালিয়ার নিকট অবস্থান নিচ্ছে। পাকসেনাদের তৎপরতা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে মুহুরী নদীর পূর্ব পাড়ে তাদের অবস্থান পাকা করে নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা আরো জানতে পারি, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়া এলাকা নিজেদের দখলে আনার জন্য তারা বদ্ধপরিকর। ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা থেকে পাকসেনারা মহুরী নদী পার হয়ে প্রচণ্ড কামানের গোলার সহায়তায় আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন যুদ্ধের পর পাকসেনাদের এই আক্রমণকে আমাদের যোদ্ধারা প্রতিহত করে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের আবার পশ্চিম তীরে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। আমাদের সেনারা যখন পাকসেনাদের ওপর সম্মুখসমরে প্রতি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল সে সময়ে গেরিলাদের বেশ কয়েকটি দল পাকবাহিনীর পিছনে আঘাত হেনে তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তোলে।

 মতিগঞ্জে গেরিলারা পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিতে আক্রমণ করে একজন অফিসারসহ ১১ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ২০ জনকে আহত করে। পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দুটি মোটরসাইকেল, তিনটি রেডিও এবং তিনটি বাক্স ঔষধ দখল করে নেয়। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা এই সংঘর্ষে শহীদ হয়। আরেকটি দল ১০ই সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় নয়াপাড়ার শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করে তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে। এখানেও আমাদের গেরিলার বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়।অপর আরেকটি গেরিলা দল ফেনীর নিকট ফতেপুর রেলসেতু ডিমোলিশন লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে পঞ্চাশ ফুটের একটি খাদের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ফেনী শহরে ও আমাদের গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পাকসেনাদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। গেরিলারা ফেনী থেকে ফুলগাজী পর্যন্ত পাকসেনাদের টেলিফোন লাইন কেটে তাদের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে ফেনী থেকে ট্রলির সাহায্যে রসদ সরবরাহ করতো। তাদের এই সরবরাহ বন্ধ করার জন্য চিতলিয়ার নিকট ঘানিমোড় রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য আমাদের পাইওনীয়ার প্লাটুন পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে রাতে পাকসেনাদের অবস্থানের পিছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন সকালে তারা সেতুটি সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে পাকসেনারা সেতুটিকে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেছে। অতিকষ্টে তারা মহুরী নদী সাঁতরিয়ে রাতের অন্ধকারে সেতুটির নীচে ডিমোলিশন লাগিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি উড়িয়ে দেয়। এর ফলে ফেনী এবং বেলুনিয়াতে পাকসেনাদের ট্রলির সাহায্যে সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।