শত্রুদের উপর আমাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখা হচ্ছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর আমাদের একটি শক্তিশালী দল কামানের সহায়তায় সন্ধ্যা সাতটায় পরশুরামের নিকট পাকঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমণ করে সাতজন পাকসেনাকে নিহত এবং পনেরজনকে আহত করে। এ পরদিন আমাদের দুটি শক্তিশালী দল সালদার এবং জগন্নাথ দীঘির শত্রুঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে চারজন পাকসেনাকে নিহত এবং অনেককে আহত করে। আমাদের এই পুনঃ পুনঃ আঘাতের ফলে পাকসেনারা বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে এবং ফেনীর দক্ষিণে তাদের কামানের অবস্থান গড়ে তোলে। সেখান থেকে আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড কামানের আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে আমাদের অবস্থান বেশ কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। পাকসেনারা তাদের কামানের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। তাদের এই কামানের ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করে দেবার জন্য ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখের সকালে আমাদের একটি কোম্পানীকে তিনটি মর্টারসহ পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে পাঠানো হয়। গোপন পথে অনুপ্রবেশ করে এই দলটি ফেনী বিমান বন্দরের পশ্চিমে বিকেলে পৌঁছে এবং পাকসেনাদের ব্রিঞ্চিতে অবস্থিত কামানঘাঁটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে রাত ১-৩০টায় পাক অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই ধরনের আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আক্রমণের চাপে উপায়ান্তর না দেখে তারা ফেনীতে অবস্থিত তাদের অন্য গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যের আহবান জানায়। ফেনী থেকে পাকসেনাদের কামানগুলি আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের দুর্ধর্ষ গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের ফেনী অবস্থানের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। দু ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের দশজনকে নিহত, ১৬ জনকে আহত এবং তাদের আরো বহু ক্ষতিসাধন করে নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসে। আমাদের কামানের আক্রমণ পাকসেনাদের ঘাঁটি যতেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এবং তারা তাদের গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের এই আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের গোলন্দাজ ঘাঁটিতে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়। ব্রিঞ্চিতে তিনটি জীপ ধ্বংস হয়ে যায়। একটি কামানেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। ফেনীতে পাকসেনাদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। বিশেষ করে পাকসেনাদের সহকারী শান্তি কমিটির সদস্য দালালরা ভয়ে ফেনী শহর পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। অপরদিকে এই আক্রমনের ফলে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের মনোবল অরো বৃদ্ধি পায়। এর পরদিন আমাদের একটি কোম্পানী সালদার শত্রুঘাঁটি রেইডিং করার জন্য পাঠানো হয়। সমস্তদিন রেকি করার পর রাত ৮-৩০- মিনিটে আমাদের কোম্পানীটি গোলন্দাজ বাহিনী এবং ৪ মর্টারের সহায়তায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো দখল করে নেয়। পাকসেনারাও তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের অগ্রসর পথে বাধা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের সৈনিকরা ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বের সঙ্গে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর তাদের হামলা অব্যাহত রাখে। পাকসেনাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমনের ফলে আমাদের অগ্রসর পথে কিছুটা বাধা আসে। কিন্তু তবুও আমাদের সৈনিকরা ডানদিক থেকে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। সকাল পর্যন্ত সংঘর্ষে পাকসেনারা তাদের অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের সৈনিকরা এই অবস্থানের পেছনে অবস্থিত একটি পেট্রোল ডাম্পও ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। শালদার অবস্থান থেকে পাকসেনাদের বিতাড়িত করার পর আমারা পরশুরামের নিকট অনন্তপুর গ্রামে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর চাপ বাড়িয়ে তুলি। প্রথমদিন এই অবস্থানে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো বিশকিছু আহত হয়। এর একদিন পর আবার অনন্তপুর গ্রামের অবস্থানের ওপর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়।
২৯শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার সময় ৪র্থ বেঙ্গলের 'বি' কোম্পানী পাকসেনাদের নয়ানপুর অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীও সহায়তা করে। যুদ্ধ প্রায় ৩০ তারিখ রাত দুটো পর্যন্ত চলতে থাকে। ছয় ঘণ্টার যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা ১০ জন পাকসেনা নিহত, ১৫ জন আহত ও ৬ জনকে বন্দী করে। তাছাড়া অনেক অস্ত্রশস্ত্রও দখল করে নেয়। পাকসেনারা মাসীরহাট থেকে আরো সৈন্য এনে