পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
123

না পেরে তারা ধীরে ধীরে পিছু হটতে চেষ্টা করে। আমাদের মুখ্য অবস্থান থেকে একটি শক্তিশালী দল তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের পাল্টা আক্রমণকারী দলটি আরো অগ্রসর হয়ে অনন্তপুর এবং ধানীকুণ্ডা পুনর্দখল করে। পাকসেনাদের প্রায় ৪০/৫০ জন অতাহত হয়। আমাদের একজন শহীদ ও ৫ জন আহত হয়। পাকসেনারা মজুমদারহাট ও চিতলিয়াতে তাদের অবস্থানগুলোতে আরো সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। আমরাও আমাদের চাপ অব্যাহত রাখি। ৪ঠা অক্টোবর তারিখ রাতে আমাদের একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের অবস্থানে অনুপ্রবেশ করে সকাল ছ'টা পর্যন্ত চিতলিয়ার নিকট পৌঁছে। সকাল ছ'টায় ৩” মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ায় পাকসেনাদের অবস্থানের দক্ষিণে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আধঘণ্টা পর্যন্ত আক্রমণের ফলে প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত করে এবং একটি আর আর ধ্বংস করে দেয়। এরপর পাক অবস্থান থেকে সরে পড়ে নিরাপদে ফিরে আসে। ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পরশুরাম, মজুমদারহাট, চিতলিয়া এবং নোয়াপড়ার উপর বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১০ জন পাকসেনা হতাহত করে। ১১ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় ফাকসেনারা পরশুরাম ও মজুমদারহাটের দিকে থেকে এক ব্যাটালিয়ন শক্তিসহ গোলানন্দাজ বাহিনী ও ৩” মর্টারের সহায়তায় আমাদের অননতপুর অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের অতি নিকটে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। কিন্তু আমাদের সৈনিকরা বীরবিক্রমে তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। সমস্ত রাত আক্রমণ চালাবার পর পাকসেনাদের প্রায় ৩৫জন সৈনিক নিহত হয়। শক্তি প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়ে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাকসেনারা তাদের মৃতদেহ ফেলে বোরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়। এই সাফল্যের ফলে আমাদের সৈনিকদের মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়। ১৩ই এবং ১৪ই অক্টোবর পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের সামনের এলাকায় তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে চলে। ১৪ই অক্টোবর সালদরের নিকট পাকসেনাদের দু'টি প্লাটুন আমাদের প্রতিরক্ষা মাইনের শিকার হয়। ফলে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৩ তারিখ সকাল ১০টার সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করে একটি মেশিনগানসহ পাঁচজন পাকসেনাকে ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ২/৩ দিন নীরব থাকার পর আবার তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১৬ই অক্টোবর আমাদের দু'টি পলাটুন বিকেল ৩-৩০ টায় পাকসেনাদের শালদার অবস্থানের উপর আবর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ২০ মিনিটের এই আক্রমণে মুক্তযোদ্ধারা পাঁচজন পাকসেনাকে নিহত ও ১০ জনকে আহত করে নিরাপদে ফিরে আসে। ওই দিনই সাড়ে চারটায় সময় আমারে গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানে হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করে এবং একটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা ১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যশক্তি নিয়ে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আমাদের সাহেবনগর, চন্দনা এবং জঙ্গলখোলা অবস্থানগুলো উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী এই অবস্থান গুলোর সাহায্যার্থে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধে আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। তাদের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি।

 কুমিল্লা দক্ষিণে জুলাই মাসের শেষের দিকে আমরা শত শত গেরিলাকে ট্রেনিং দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিই। এইসব গেরিলা কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, হাজীগঞ্জ, বতরা, চাঁদপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি জায়গাতে প্রবেশ করে নিজ নিজ জায়গায় বেইস তৈরী করে তোলে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের একটি টহলদারী দলকে বোয়াল নামক স্থানে এ্যামবুশ করে। এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের গেরিলারা দখল করে নেয়। লাকসাম থানার সাহাপুর গ্রামে পাকসসেনাদের একটি ছোট ঘাঁটি ছিল। লাকসামের গেরিলারা ৫ই আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার সময় এই ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দলের দুটি প্লাটুন মিয়াবাজারের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটির বিস্তারিত সংবাদ পায়। তিনটি পাল্টুন- এর এই দলটি ৭ তারিখ রাত পৌনে তিনটার সময় সেই ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। প্রায় আধঘণ্টা যুদ্ধের ফলে ২৮ জন পাকসেনা নিহত এবং একজন অফিসরা ও জেসিওসহ ১২ জন আহত হয়। বেশ কিছুসংখ্যক বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়।