বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
124

সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণে এবং কুমিল্লার দক্ষিণে কৃষ্ণনগর, কলাতলা, আমজাদহাট প্রভৃতি জায়গায় আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের উপর বিভিন্ন সময়ে আঘাত হেনে প্রায় ২০ জনকে নিহত ও ১৬ জনকে আহত কেরে। এসব সংঘর্ষে আমাদের ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৩ জন আহত হয়। সেপেটম্বরের ২০ তারিখে আমাদের একটি গেরিলা দল চট্টগ্রাম-কুমিল্লার রাস্তায় জগন্নাথ দীঘির নিকট বাজানকারা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে সেতু থেকে কিছু উত্তরে ১০ জন গেরিলা ও একটি নিয়মিত বাহিনীর পাকসেনাদের অপেক্ষায় এ্যামবুশ পেতে বসে। সেতুটি ধ্বংসের সংবাদ পেয়ে ফেনী থেকে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। সেতুতে পৌঁছার আগেই পাকসেনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে একজন অফিসারসহ ২৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফেনীর দিকে পালিয়ে যায়।

 পাকসেনারা লাকসামের নিকট হাসনাবাদ নামক এক জায়গায় তাদের একটি ঘাঁটি তৈরী করে। তাদের সঙ্গে বেশ কিছুসংখ্যক রাজাকারও ছিল। এই ক্যাম্প থেকে তারা চাঁদপুর-লাকসাম-কুমিল্লা রাস্তায় অনবরত টহল দিয়ে বেড়াতো। ফলে চাঁদপুরে এবং দক্ষিণ ঢাকা ও ফরিদপুরে অনুপ্রবেশকারী আমাদের গেরিলাদের জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার দৃষ্টি হয়। এই ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দেবার জন্য ক্যাপ্টেন মহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুব এই ঘাঁটিটি সম্পর্কে পুরোপুরি সংবাদ সংগ্রহ করে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের 'বি' কোম্পানী ও গেরিলা সমন্বিত একটি শক্তিশালী দল লাকসাম এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং পরদিন পাকসেনদের হাসনাবাদ ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। ফলে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা ও ৩০ জন রাজাকার নিহত হয়। পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। হাসনাবাদ অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে। এই সংঘর্ষের একদিন পর আমাদের দলটি হাজীগঞ্জে অবস্থিত রাজাকারদের একটি বিরাট ট্রেনিং ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ৩০ জন রাজকারকে নিহত করে। এর ফলে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রবেশ পথটি আবার বিপদমুক্ত হয়। পাকসেনারা এই অঞ্চলে আমাদের ধ্বংস করার জন্য আরো সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। তাদের একটি ব্যাটালিয়ন চৌদ্দগ্রামে মোতায়েন হয়। পাকসেনাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার একটি মাদ্রাসা বিল্ডিং-এ স্থাপন করে। এইসব সংবাদ আমাদের কাছে স্থানীয় গেরিলাদের মারফতে পৌছে। পাকসেনাদের এই নতুন ব্যাটালিয়নটিকে আসার সাথে সাথেই ব্যতিব্যস্ত করে তোলার জন্য লেঃ ইমামুজ্জামান সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে আমাদের মর্টার পল টুন ও একটি গেরিলা দলকে চৌদ্দগ্রামে পাঠায়। আমাদের দলটি বিকেল পাঁচটায় চৌদ্ধগ্রামের নিকট উপস্থিত হয়ে পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টাররের উপর মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। বেশ ক'টি গোলা মাদ্রাসা ঘরের মধ্যে পড়ে। এর ফলে পাকসেনাদের প্রায় ৩০/৪০ জন হতাহত হয়। আমাদের একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় গেরিলা আহত দের লাকসামের দিকে নিয়ে যেতে দেখে। পাকসেনারা কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর গোলাগুলি চালায়। এতে কিছু বেসামনিক লোক নিহত হয়। এর দু'দিন পর পাকসেনাদের একটি দল হরিসর্দার বাজারের নিকট স্থানীয় দালাল, শান্তি কমিটির লোকদের নিয়ে এক সভায় মিলিত হয়। এই সভা পণ্ড করে দেয়ার জন্য আমাদের একটি টহলদার দল পাকসেনাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে একজন জে-সি-ওসহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। শান্তি কমিটির লোকেরা ভয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা সেপ্টেম্বর মাসেই চৌদ্দগ্রামের উত্তরে হরিসর্দার বাজারের নিকট পুনরায় নতুন করে তাদের ঘাঁটি তৈরী করার চেষ্টা চালায়। এই সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামান পাকনেসাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবর সংগ্রহ করার জন্য রেকি দল পাঠায়। রেকি দলটি রাত ৯টার সময় খবর সংগ্রহ করে ফেরত আসে। তারা দেখতে পায়, পাকসেনাদের প্রায় এক কোম্পানী শক্তি হরিসর্দার বাজারের উত্তরে ঘাঁটি তৈরী করার জন্য ট্রেঞ্চ খোঁড়ায় ব্যস্ত। সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামানের ৪র্থ বেঙ্গলের “বি” কোম্পানী এবং দু'টি গেরিলা কোম্পানী নেয়ে মর্টারের সহায়তায় রাত সাড়ে ৪টার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের তীব্র আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের দুটি হালকা মেশিনগান পোস্ট ছাড়া সম্পূর্ণ অবস্থানগুলি পর্যুদস্ত হয়ে যায়। পাকসেনারা তাদের বাঙ্কার থেকে আক্রমণেরে চাপে পালাবার চেষ্টা করলে আমাদের সৈনিকরা তাদের নিহত করে। প্রায় ২৫ জন পাকসেনা রেঞ্জারসহ নিহত হয় ও অনেকে আহত হয়। দু'ঘণ্টা আক্রমণ চালাবার পর