বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
140

অগ্রবর্তী ঘাঁটি নিলক্ষ্মীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা সাহসে সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণে বাধা দেয়। কিন্তু প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে মূল ঘাটির ফিরে আসে। পাকসেনারা নিলক্ষ্মী অগ্রবর্তী ঘাটিটি দখল করে নেয়। পরদিন সকালে ১০ম বেঙ্গলের তিন কোম্পানী আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় নিলক্ষ্মীর ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। সকাল ১০টা পর্যন্ত তিনঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। প্রচণ্ড চাপে পাকসেনারা টিকতে না পেরে নিলক্ষ্মী ঘাঁটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। আমাদের সৈনিকরা নিলক্ষ্মী পুর্দখলের পর পুতিরক্ষাব্যূহ মালিবিলদ ও গাবতলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে। পরদিন সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের একটি প্লাটুন দুবলা চাঙ্গের নিকট একটি এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি দল বেলুনিয়া যাবার পথে সেই এ্যামবুশ-এ পড়ে। আমাদের প্লাটুনটি পাকসেনাদের আক্রমণে চালিয়ে ১৩জন পাকসেনাকে নিহত করে এবং ২জন পাকসেনাকে জীবিত বন্দী করে। এছাড়া অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়। নিলক্ষ্মীতে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হওয়ার পার পুনঃআক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। ২৯শে অক্টোবর ভোর ৪টার সময় পাকসেনারা শালদার নয়াপুর এবং ফুলগাজী থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর কামানের সাহায্যে প্রচণ্ড গোলাবর্ষন শুরু করে। আমাদের কামানগুলিও পাকসেনাদের গোলার প্রত্যুত্তর দেয়। সকালে পাকসেনারা তিন দিক থেকে আমাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ৫ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে পাকসেনাদের আক্রমণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাড়ে বারোটার সময় পাকসেনাদের আক্রমণ সম্পূর্নভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড বাধার সামনে টিকতে না পেড়ে পাকসেনারা পিছন দিকে পালিয়ে যায়। সংঘর্ষে ৪০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের দু'জন সৈনিক শহীদ হয়।

 এই সময় পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ঘাটি চিতলিয়া; পরশুরাম ও বেলুনিয়া থানার নিকট ছিল। এসব ঘাটিগুলোতে রেলওয়ে ট্রলির সাহয্যে পাকসেনারা ফেনী থেকে রসদ যোগাতো। ৫ই নভেম্বর রাতে আমাদের একটি রেইডিং পার্টি চিতলিয়ার দক্ষিনে রেলওয়ে লাইনের উপর এ্যামবুশ পাতে। ৬ই নভেম্বর সকাল ৭টায় পাকসেনাদের একটি ট্রলি আমাদের হেডিং পার্টির এ্যামবুশ এর আওতায় এসে যায়। ট্রলিটিকে সম্পূর্নরুপে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ চারজন সৈনিক নিহত হয়। আমাদের রেইডিং পার্টি একটি হালকা মেশিনগান, ১টি রাইফেল, ১টি স্টেনগান, ১টি ব্লেনডিসাইড, ২০০০ রাউণ্ড গুলি ও ১০টি ব্লেনডিসাইড গোলা হস্তগোত করেক। ১০ম বেঙ্গল পাকসোদের আক্রমণকে ব্যর্থ করার পর বেলুনিয়া থেকে পাকসেনাদের সম্পূর্ণরুপে বিতাড়িত করার জন্য পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে পরশুরাম ও চিতলিয়ার মাঝে পাকসেনাদের সরবরাহ লাইনের সড়কটি বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নেয়। ৬ই নভেম্বর ১০ম বেঙ্গলের একটি কোম্পানী গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ার উত্তরাংশে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যূহের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্ট যুদ্ধের পর ১০ম বেঙ্গলের কোম্পানীটি চিতলিয়ার উত্তরাংশ দখলকরে নিয়ে সালিয়া এবং ধানীকুণ্ডার মাঝখানে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরশুরাম ও ফেনীর মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সমর্থ হয়। এর ফলে বেলুনিয়ার উত্তরাংশের পাকসৈনিকরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। একজন অফিসারসহ ১২জন পাকসেনা যুদ্ধে নিহত এবং পাঁচজন বন্দী হয়। অফিসারের পকেট থেকে প্রাপ্ত এম-ও ফর্ম থেকে জানা যায় যে সে ১৫তম লুেচ জজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন এবং বেলুনিয়াতে সে সময় ১৫তম বেলুচ রেজিমেণ্ট আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই সংঘর্ষে আমাদের মর্টার প্লাটুন কমাণ্ডার হাবিলদার ইয়ার আহমদ শহীদ হয় এবং আরো ৫ জন আহত হয়। পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। পাকসেনারা চিতলিয়ার দক্ষিনে পশ্চাদপসরণ করে। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের চিতলিয়ার অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য পাকসেনারা পরদিন ভোর ৫টায় দু' কোম্পানী শক্তি নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের কোম্পানীটি গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় অসীম সাহসের সঙ্গে এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। আপ্রাণ চেষ্টাসত্ত্বেও আমাদের সৈনিকদের গুলির সামনে এবং গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার মখে পাকসেনাদের এই আক্রমণটি ব্যর্থ হয়ে যায়। ৩৫জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেক আহত হয়। কয়েকটি হালকা মেশিগানসহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়।