পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
143

পিছন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছি। উপায়ন্তর না দেখে সবকিছু ফেলে তারা চট্টগ্রামের দিকে পালাতে থাকে। পালাবার পথে আমাদের মর্টারের এবং মেশিনগানের গুলিতে অনেক পাকসৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ৪০ জন হতাহত পাকসেনাকে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে পাই। ৮জন পাকসেনা বন্দী হয়, ৪৯জন ইপিসিএএফ অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। প্রচুর গোলাবারুদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমাদের হস্তগত হয়। রেশন বোঝাই কয়েকটি ট্রাকও আমাদের দখলে আসে। পালাবার সময় পূর্ব থেকে লেঃ শওকতের গণ-বাহিনীর কোম্পানীও পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং অনেককে হতাহত করে। পাকসেনারা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় ১৪ই ডিসেম্বর নাজিরহাট সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। আমাদের একজন শহীদ ও ১জন সৈনিক আহত হয়। পাকসেনারা নাজিরহাট সড়কসেতু আগে থেকেই ধ্বংস করে দিয়েছিলো। সেজন্য নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রযাত্রা একদিন দেরি হয়ে যায়। নাজিরহাটের স্থানীয় জনগণের সাহায্যে সেই সেতুটির আংশিক পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয় এবং ১৫ই ডিসেম্বর নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে আমাদের অগ্রাভিযান পুনরায় শুরু হয়। সকালে হাটহাজারী পৌছার পর ১০ম বেঙ্গলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ১০ম বেঙ্গল মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে সীতাকুণ্ড হয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিল। হাটহাজারীতে যোগাযোগের পর ‘কে-ফোর্স'-এর ১০ম বেঙ্গল ও ৪র্থ বেঙ্গল সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করে। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে এই সম্মিলিতবাহিনী চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রাম শহর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এই সময় বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়পার্টার আক্রমণে স্থগিত রাখার নির্দেশ পাঠায়। আরো খবর আসে যে, পাকসেনারা ওইদিন আত্মসমর্পণ করবে। ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৪-৩০ মিনিটে পাকসেনাদের এক ডিভিশন সৈন্য 'কে ফোর্স-এর কিট অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পন করে। পাকনোদেরকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চট্টগ্রাম সেনানিবাস, নৌঘাঁটি ট্রানজিট ক্যাম্প প্রভৃতি জায়গায় বন্দী করে রাখা হয়। সমস্ত চট্টগ্রাম ‘কে-ফোর্স'-এর নিয়ন্ত্রন আসে। স্বতঃস্ফুর্ত জনগণ বিজয়মাল্যে ভূষিত করে আমাদের বিজয়ী বীর সৈনিকদের নিয়ে বিজয় উল্লাসে শহর প্রদক্ষিণ করে।

 ১১ই এবং ১২ই নভেম্বর ৯ম বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানী এবং 'বি' কোম্পানী কৃষ্ণপুর ও বগাবাড়ি অবস্থান থেকে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে কুমিল্লার দিকে আরো পিছু হটিয়ে দেয়। দু'দিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ১৪জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে ২ জন শহীদ এবং একজন আহত হয়। এই সময় ৪র্থ বেঙ্গল শালদা নদীর দিক থেকে পাকসেনাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এই দুই ব্যাটালিয়নের আক্রমণে পাকসেনারা পরাস্ত হয়ে শালদা নদী কসরা; মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকা সম্পূর্নরুপে পরিত্যাগ করে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লাতে আশ্রয় নেয়। ডিসেম্বর মাসের ১লা তারিখে কুমিল্লার উত্তর এলাকা সম্পূর্নরূপে শত্রু মুক্ত হওয়ার পর চারটি সেক্টর কোম্পানীকে এই এলাকা মোতায়েন রেখে ৯ম বেঙ্গলকে কুমিল্লার দক্ষিণ পূর্বে মিয়ারবাজার এলাকায় সমাবেশ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখে ৯ম বেঙ্গল মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। মিয়াবাজারে ক্যাপ্টেন মাহবুবের ছয়টি সেক্টর কোম্পানীও তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। ৩রা ডিসেম্বর সকালে এই সম্মিলিত বাহিনী মিত্র বাহিনীর কামানের সহায়তায় মিয়াবাজারে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যূহের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লার দিকে পিছু হটে যায়। মিয়াবাজারে শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম বেঙ্গলের একটি দলকে লাকসামের দিকে অগ্রসর নির্দেশ দিয়ে মেজর আইনউদ্দিন কুমিল্লা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। যাত্রাপথে শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যূহ ধ্বংস করে অগ্রাভিযানের গতি অব্যাহত রেখে ৪ঠা ডিসেম্বরের ভোরে মেজর আইনউদ্দিনের দল কুমিল্লার বিমানবন্দর এলাকা পর্যন্ত পৌঁছতে সমর্থ হয়। কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ৯ম বেঙ্গল মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় এই ঘাঁটিটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই আক্রমণ পতিহত করতে না পেরে কুমিল্লা শহরের দিকে পালিয়ে যায়। দুপুর পর্যন্ত সমস্ত কুমিল্লা বন্দর এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং ৯ম বেঙ্গলের দুটি কোম্পানী কুমিল্লার দক্ষিণ এবং পূর্ব দিক (রাজগঞ্জ বাজার) থেকে কুমিল্লা শহরের অভ্যান্তরে প্রবেশ