আক্রমণ করার পরিকল্পনা বন্ধ করি। ১৬ তারিখে যখন পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে তখন আমি কুমিল্লা সেনানিবাসে উপস্থিত ছিলাম।
সাক্ষাৎকারঃ মেজর গাফফার[১]
জুন মাসের শেষে শালদা এক রকম আমার নিয়ন্ত্রণেই ছিল্ আমি আমার নিজ সাবসেক্টর রেকি করে জানতে পারি, শালদা নদী গোডাউনে ৩০০০ মণের মত গম এবং চাল মজুদ আছে। খাদ্যসামগ্রীর প্রয়োজন আমাদের অতিরিক্ত ছিল। কেননা এতদিন পর্যন্ত স্থানীয় লোকের খাদ্যসামগ্রীর উপর নির্ভর করেই আমরা জীবনধারণ করছিলাম। তারা যা খেতে দিত তাই আমরা খেতাম। জনসাধারণের এ সহযোগিতা না পেলে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতাম না। কিন্তু জনসাধারণের খাদ্য সাহায্য পর্যাপ্ত ছিল না। অনেক সময় আমাদের ফলমূল ও পানি খেয়েই জীবনধারণ করতে হয়েছিল।
শালদা নদী গোডাউনে খাদ্যসামগ্রীর কথা আমার সেক্টর কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফকে জানাই। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন ৩০০০ মণ গম ও চালক যেন তাড়াতাড়ি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি শালদা নদী গিয়ে ৩০টা নৌকা যোগাড় করে স্থানীয় এবং আমার সৈনিকদের সাহায্যে সমস্ত খাদ্যসামগ্রী নৌকাতে বোঝাই করি। কিন্তু স্থানীয় দালালরা আমাদের এ খাদ্রসামগ্রী সরানোর খবর কুটিতে অবস্থিত শত্রুসেনাদের জানায়। শত্রুরা কুটি থেকে গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে কামান থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ গোলাগুলির মধ্যে আমরা সুন্দরভাবে আমাদের কাজ সম্পন্ন করি।
আমি কসবাতে দুটি কোম্পানী গঠন করি। একটি কোম্পানী ৪র্থ বেঙ্গল-এর 'সি' কোম্পানী নিয়ে গঠিত ছিল-অপর কোম্পানী ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং স্থানীয় লোকদের নিয়ে। আমি তাদের একমাস ধরে ট্রেনিং দেই এবং কোম্পানীতে অন্তর্ভুক্ত করি। তাদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাতে শুরু করি। ঐ সমস্ত গ্রামের লোকেরা শত্রুদের গতিবিধির খবর দিয়ে, খাবার দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
আমি কসবার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যেতে থাকি। শত্রুরা যখনই প্রবেশের চেষ্টা করেছে তখনই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তারা পশ্চাদপসরণ করেছে। আমি ঐ এলাকার রেললাইন তুলে ফেলে, রেললাইনের সেতু ও রাস্তার সেতু ভেঙ্গে দিয়ে শত্রুদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেই। ইলেকট্রিক পাইলন, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের থামও উড়িয়ে দেই। এ সমস্ত করার ফলে শত্রুরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হয়।
আমার কোন টেলিফোন সেট ছিল না। কিন্তু একমাসের মধ্যে শত্রুদের উপর হামলা চালিয়ে অনেক ক্যাবল ও টেলিফোন সেট দখল করি এবং তার পরই আমি বিভিন্ন কোম্পানীর মেধ্য যোগাযোগ করার জন্য টেলিফোন লাইন স্থাপন করি। এর ফলে আমার বাহিনীকে নেতৃত্ব ও নির্দেশ দেওয়া আমার পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) আমাদের উপর নির্দেশ দেন, শত্রুদের সাথে সামনাসামনি লড়াই না করে তাদের উপর আচমকা আক্রমণ চালাবার। তিনি এ্যামবুশ, রেইড ও সেতু ধ্বংস, যাতায়াতের ক্ষতিসাধন ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে শত্রুদের ক্ষতি হবে ব্যাপক এবং সে অনুপাতে আমাদের ক্ষতি হবে সামান্য। এ কৌশল খুবই
উপযোগী হয়েছিল। এতে আমাদের সৈনিকদের মনোবল বেড়ে যায়। প্রতিদিন প্রতিরাতে শত্রুদের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের অনেকেই নিহত বা আহত করছিলাম। শত্রুরা এক স্থান থেকে আরেক স্থান
- ↑ ১৯৭৩ সালে এ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। জনাব গাফ্ফার একাত্তরের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টে এ্যাডজুটেণ্ট হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন।