পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
157

 এ সময়ে আমাদের সেক্টর-২ এর কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ খবর পাঠানে যে, ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জেনারেল অরোরা হেলিকপারে করে আমাদের অবস্থান দেখতে আসতে পারেন। তারই হেলিক্চারে গুলি না চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু আমার মনে হয় পাকসেনারা এ খবর পেয়ে গিয়েছিল, ফলে তিনি আর আসতে পারেননি।

 তখন ছিল বর্ষাকাল। ২০শে জুন সারাদিন সারারাত ধরে বৃষ্টি হচিছল। ২১ শে জুনের আকাশ ছিল মেঘলা এবং ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি সকাল থেকে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে বিরাজ করছিল অস্বস্তি। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কাছে যাই সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনার জন্য। বিকেল ৫টা সময় আমি আমার অবস্থানে ফিরে আসি। আমি আমার সমস্ত কমাণ্ডারকে ডেকে পাঠাই। রাত্রে আমরা আমাদের অবস্থানে আলো জ্বালাতাম না, কেননা আলো জ্বালালেই শত্রুদের দৃষ্টিগোচর হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই খাওয়া-দাওয়া আলো শেষ হবার আগেই সেরে ফেলতে হতো। আমার বাঙ্গারে যখন ২টা রুটি ডাল সহযোগে খেতে বসেছি তখন হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাই। আমার আরদালী দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দেয় দুটি হেলিকপ্টার আমার হেডকোয়ার্টারের পিছনে উড়ছে-যা পশ্চিম দিক অর্থাৎ ভারতে দিক থেকে আসছে। আমি ভাবলাম ২৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত বৃষ্টি হবার জন্য হয়ত জেনারেল অরোরা কাল আসতে পারেননি, আজ আস্তে আস্তে বৃষ্টি হচ্ছে তাই এসেছেন। এ চিন্তা করে কিভাবে তাঁকে সম্ববর্ধনা জানাবো ভেবে হেলিকপ্টারের দিকে দৃষ্টি রাখি। হেলিকপ্টার দুটি অতি নিচু দিয়ে ১৮০ ডিগ্রি যাবার পর দুটি দুদিকে যায়। ১টি হেলিকপ্টার বাঁ অবস্থানে পূর্বদিকে এবং এন্যাটি আমার হেডকোয়ার্টারের উপর দিয়ে উত্তর দিকে ১০০০ গজ পর্যন্ত যায়। সন্দেহ জাগে দুটি হেলিকপ্টার দু'জায়গায় নামছে কেন? হঠাৎ আমার মনে সন্দেহ জাগে এবং আমার বিশেষ প্লাটুনের কমাণ্ডার নায়েক সুবেদার শহীদকে ডেকে পাঠাই। ১৫ মিনিট অতিক্রান্ত হবার পর দেখি দুটি হেলিকপ্টারই ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ বাঁ দিক ও পিছন দিক থেকে গুলি আসতে থাকে। তখন ছিল অন্ধকার। শত্রুরা গ্রেনেড, এম-জি ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। আমি সহজেই বুঝতে পারি এটা পাকিস্তানী কমাণ্ডোদের কাজ। আমি বুঝতে পারি এটা জেনারেল অরোরার হেলিকপ্টার নয়, শত্রুরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে পেছনে অবস্থান নিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে নায়েক সুবেদার শহীদ এবং ই-পি-আর এর সুবেদার ফরিদ আহমেদকে নির্দেশ দেই সমস্ত সৈন্যদের অতিসত্বর আমার নিকটে হাজির করার জন্য। তারা সমস্ত পরিস্থিতি বুঝতে পারে এবং ১০ মিনিটের মধ্যে এসে খবর দেয়। আমি দ্রুততার সঙ্গে নতুনভাবে আমার বাহিনীকে সজ্জিত করি। প্রধান রাস্তা এবং রেললাইনের উপর তাদের অবস্থান নিতে বলি এবং আরও বলি আমি গুলি চালালে তোমা গুলি চালাবে। এ রাত ছিল খুবই অন্ধকার এবং কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আমি আমার বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান (সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড) সুবেদার খুরশিদ আলমকে উত্তর এবং পশ্চিম দিকের প্রতি নজর রাখতে বলি এবং আমি পূর্ভ এবং দক্ষিণ দিকে নজর রাখি। পাক কমাণ্ডোদের হামলার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ আমার জীবনে এক চরম পরীক্ষা ছিল। একটু ভুল করলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব। সে রাতের কথা মনে পড়লে আজও আমার শিরণ জাগে। এ সময়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে খবর পাঠান যে তিনি এফডিএল-এর (ফরোয়ার্ড ডিফেণ্ডেড লোকালিটি) পথ দিয়ে এগোচ্ছেন। পাক গোলন্দাজ বাহিনী কামান, মর্টার, আর-আর-এর সাহায্যে আমাদের উপর অবিরাম বৃষ্টির মত গোলা ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টির মত গোলাগুলি ২ ঘণ্টা ধরে চলে। কিন্তু আমরা তাদের সামনে অগ্রসরের চেষ্টা রুদ্ধ করে দেই। ইতিমধ্যে দ্বিতীয়বারের মত হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাকবাহিনী পিছনে আবার তাদের কমাণ্ডোদের নামিয়েছে। রাত ৯টার সময় লেঃ ইমামুজ্জামানের কাছ থেকে খবর পাই তারা পাকসেনা কর্তৃক আকান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে মর্টার সেকসনের কমাণ্ডার সুবেদার জববার খবর পাঠায় যে, মর্টার সহযোগিতা করা আর সম্ভব নয়, কেননা ইতিমধ্যে সমস্ত মর্টার শেষ হয়ে গেছে। সাহায্য পাবার আশা না থাকায় আমি একিনপুর থেকে অবস্থান সরিয়ে নেই। লেঃ ইমাম আমাকে ফোনে খবর পাঠায় পাক কমাণ্ডোরা সামনে থেকে তাদের আক্রমণ চালিয়েছে এবং পাঠাননগরের দিকে এগোচ্ছে। তার কাছে আর গোলাবারুদ নেই। আমাকে সে অনুরোধ জানায় কিছু গোলাবারুদ যেন অতি সত্বর ইমামুজ্জামানের কাছে পাঠায়। লেঃ ইমাম আমাকে আরো জানায় ছাগলনাইয়া