পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
160

লাটুমুড়া পাহাড়ী এলাকাটিসহ সমগ্র কসবা এলাকা দখল করে নিয়েছে। যাহোক, আমি আমার কোম্পানী যোগাড় করে শালদা নদী-কোনাবনের দিকে অগ্রসর হই। ক্যাপ্টেন সালেক ছিলেন শালদা নদী সাবসেক্টরের কমাণ্ডার। মন্দভাগ-কোনাবনে আমাদের সৈন্যই ছিল না। শত্রুরা শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন, ‘বায়েক, মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন দখল করে রেখেছিল। যাহোক আমি আমার হেডকোয়ার্টার কোনাবনে স্থাপন করি। সে থেকে আমার সাবসেক্টর কোনাবন সাবসেক্টর বলে পরিচিত ছিল। আমার সাবসেক্টর উত্তরে কসবা জাদেশ্বর এবং দক্ষিণে ‘বায়েক’ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। পূর্ব পশ্চিমে ছিল সি-এণ্ড-বি সড়ক বরাবর কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত। আমি আমার সমস্ত সাবসেক্টর জুড়ে রেকি করি এবং কোম্পানী কমাণ্ডারদের নিয়ে কোম্পানীগুলিকে পুনর্গঠিত করে ফেলি। আমার প্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল আমার বাহিনীকে নিয়ে একটা স্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আমি অন্যান্য সাব-সেক্টর কমাণ্ডারদের মত হেডকোয়ার্টার ভারতে স্থাপন করা মনঃপূত মনে করিনি। তাই আমার হেডকোয়ার্টার কোনাবনে স্থাপন করি।

 ৩০শে জুন সকালে শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করি। ৫ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার পর বেলা সাড়ে ১২টার সময় শত্রুরা মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে চলে যায়। মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন দখল করার পর ঐ দিনই আরও ৪/৫টা গ্রাম মুক্ত করে নেই। এভাবে আমি প্রতিরক্ষাব্যূহ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা বরাবর গড়ে তুলি। সন্ধ্যা পর্যন্ত দু'বার শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর শত্রুরা অনেকবার চেষ্টা করেছিল এ এলাকা দখল করার জন্য কিন্তু পরম করুণাময় আল্লার রহমতে তাদের প্রচেষ্টা দেশ মুক্তি হবার আগে পর্যন্ত সফল হয়নি। প্রায় ৪ লক্ষের মত লোক পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেয়। তাদের আত্মত্যাগের কথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা দরকার। তারা আমাদের মনোবল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা অনেক কাজে আমাদের সাহায্যও করত। পাকসেনারা মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিতাড়িত হবার পর মন্দভাগে আশ্রয় নেয়। মন্দভাগ বাজার, আড়াইবাড়ি ও নয়নপুরে তারা সাঁজেয়া ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আসে। আমরা কোন অপারেশন করলেই শত্রুরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের এলাকায় কামানের গোলা ফেলত।

 এরপর আমি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে ‘বায়েক' গ্রাম দখল করার পরিকল্পনা নেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমরা যখন বাঙ্কার থেকে উঠে আসতাম, তখন এ গ্রামে অবস্থানরত শত্রুসেনারা আমাদের উপর গুলি ও ৮২-এম-এম চাইনিজ মর্টারের সাহায্যে গোলা চালাত। ঐ গ্রাম আমি দখল করে নেই এবং শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি।

 এই দুই আক্রমণে আমার বাহিনীর বেশ হতাহত হবার ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম, এ, জি, ওসমানী নির্দেশ পাঠান সামনাসামনি যুদ্ধ না করার। শত্রুদের ক্ষতিসাধন করার জন্য তিনি এ্যামবুশ এবং হঠাৎ করে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন।

 কর্ণেল ওসমানীর নির্দেশ পাবার পর আমি আচমকা আক্রমণের পথকেই বেছে নেই এবং এতে প্রভূত সাফল্য লাভ করি। আমি এ পরিকল্পনার জন্য 'সি' কোম্পানীর ১টা প্লাটুনকে নিয়োগ করি এবং ১টা কোম্পানী ও অন্যান্য সৈন্যদের মুক্ত এলাকায় রাখি শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। ই-পি-আর' এর সুবেদার গোলাম আম্বিয়ার নেতৃত্বে ১টা কোম্পানী ২নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর খালেদ আমার নিকট পাঠান। সুবেদার গোলাম আম্বিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। পরে আমাকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল-এর নেতৃত্ব দেয়া হয়। তখন আমি ১৫ই আগস্টে 'ডি' কোম্পানী গঠন করি সুবেদার আম্বিয়ার কোম্পানীকে নিয়ে। এই দুই কোম্পানী স্বাধীনতার যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এই দুই কোম্পানী কসবার দক্ষিণ থেকে বায়েক পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং ক্যাপ্টেন খালেকের সৈন্যরা কাটামোড়া থেকে গৌরাঙ্গতলা ও নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।