পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
161

 পূর্বেই উল্লেখ করেছি গেরিলা তৎপরতার জন্য আমি ১ টা প্লাটুনকে নিয়োজিত রেখেছিলাম। বাছাই করা লোকদের এ কাজে নিয়োগ করি। এ কাজে আমি একজন অতি সাহসী জুনিয়র কমিশন অফিসারকে পাই। সে হচ্ছে সুবেদার ওহাব। তার নাম স্বাধীনতা যুদ্ধের পথপ্রদর্শক হিসেবে লিখিত থাকা উচিত। সে নিজের জীবনের মায়া, সুখ ত্যাগ করে সত্যি প্রকৃত বাঘের মত শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে কোনদিন কোন অভিযোগ আমার কাছে করে নাই। এমনকি অনেকদিন অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছে। তাকে যে কাজের ভার দেয়া হয়, তা সাফল্যের সাথে করে। কোন অপারেশনে সে কোনদিন বিফল হয়নি। এ প্রসঙ্গে আমি আরেক জনের নাম করব। সে হচ্ছে মর্টার সেকশনের শামসুল হক। তার নিখুঁত সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল পাকসেনাদের বিপর্যস্ত করা। তার কাজের জন্যই সাবসেক্টর শত্রুদের জন্য কবরস্থানে পরিণত হয়েছিল। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি দেশ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে ও তার আশেপাশের এলাকা শত্রুমুক্ত রেখেছিলাম।

 আমি মুক্ত এলাকাগুলি নিয়ে একটা মুক্ত সাব-ডিভিশন গঠন করি। সেখানে বাজার, স্কুল, থানা, বেসামরিক প্রশাসন চালু রাখার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করি। মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা গৌরবের সাথে উড়তে থাকে। এ মুক্ত এলাকা দেখার জন্য দেশ-বিদেশের নাম করা সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও গণ্যমাণ্যরা দেখতে আসতে থকে। আমাদের পক্ষে অসুবিধা হয়ে পরেছিল ঐ সমস্ত গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সমস্ত কিছু দেখাতে এবং বুঝাতে। এ প্রসঙ্গে আমি মুক্ত এলাকার লোকের কথা স্বরন না করে পারি না এদের অনেক শত্রুদের গোলার আঘাতে মারা গেছে বা গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। তবুও তাদেও মনোবল একটুও ভাঙ্গেনি। তারা আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্যে করে যেতে থাকে। তারা বাঙ্কারে গোলাবারুদ পৌছিয়ে দিত, মৃত শহীদের কবরের ব্যবস্থা করতো, আহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রূষা করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করতো। তাদেও অনেকে নৌকায় করে বিভিন্ন স্থানে পৌছিয়ে দিত। অনেকে শত্রুদের খবরাখবর এনে দিত। এ খবরাখবর না পেলে শত্রুদের উপর ঠিকমক হামলা করতে পারতাম না। এদের সাহায্য নিয়েই আমি শত্রুসেনাদের উপর আক্রমন চালিয়ে তাদের অনেক অফিসার ও সৈনিকদের শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

 আমি শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে শত্রুদের যাওয়া-আসা এবং রসদ সরবরাহের প্রতি লক্ষ্য রাখতাম। ৩৩ বেলুচ রেজিমেণ্ট মন্দভাগ বাজারে ঘাটি গেরেছিল। কোম্পানীগঞ্জ থেকে স্পীডবোটের মাধ্যমে শালদা নদী হয়ে মন্দভাগ বাজার ও শালদা নদী স্টেশনে অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটিতে তাদের রসদ আসতো। সেদিনটি ছিল আমাদের জন্য খুব ভাল দিন। রাত দুটার সময় আমি সুবেদার ওহাব ও তার প্লাটুন নিয়ে বারদুরিয়াতে অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটি আক্রমন করতে গিয়েছিলাম। এ্যাকশেন শেষ করে পরের দিন সকাল ৮দিকে গুপ্তপথে আমাদেও অবস্থানে ফিরে আসছিলাম। সত্যিকথা বলতে কি আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। সেজন্য একটি ঝোঁপের মধ্যে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ৩টা স্পীডবোটের আওয়াজ শুনতে পাই যা কোম্পানীগঞ্জ থেকে আসছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই স্পীডবোটগুলি আহত সৈনিকদের নিয়ে আবার কোম্পানীগঞ্জ ফিরে যাবে। আমি এ ব্যাপারে সাহসী যোদ্ধা সুবেদার ওহাবের সাথে আলোচনা করি এবং দ্রুত শালদা নদীর একটা নির্বাচিত এলাকার ঝোঁপে গিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। নদীর অপর পর্শ্বে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে ওহাবের অধীনে একটা সেকশন পাঠিয়ে দেই এ্যাম্বুস পাতার জন্য এবং আমি নিজে দুটো সেকশন নিয়ে নদীর পূর্বপাড়ে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে এ্যামবুশ পাতি। আধঘণ্টার মধ্যেই মন্দভাগ থেকে স্পীডবোট আসার আওয়াজ শুনতে পাই। দুটো স্পীডবোট আমাদের ফাঁদে পা দেবার জন্য এগিয়ে আসছিল। আমি আমার সৈনিকদের নির্দশ দেই আমি গুলি না ছোড়া পর্যন্ত তারা যেন কেউ গুলি না চালায়। দুটো স্পীডবোট ১৫০ গজের ব্যবধানে এগিয়ে আসতে থাকে। স্পীডবোটগুলি ছিল খোলা এবং প্রথম স্পীডবোটে দেখি ২/৩টি ছতার নিচে লোক বসে আছে এবং পিছনেরটিতে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে সৈন্য বোঝাই হয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত হলাম প্রথম স্পীডবোটে ছাতার নিচে পাকসামরিক অফিসাররা বসে আছেন। নদী ছিল ৩০/৪০ গজ প্রশস্ত। দুটি স্পীডবোটেই যখন আমার ফাঁদে