পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
162

পড়ে যায় তখন আমি শত্রুদের দিকে গুলি চালাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাহিনীর লোকেরা শত্রুদের উপর এক সঙ্গে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণ চলে ৫ মিনিট ধরে এবং শত্রুরা এ আক্রমণের কোন জবাব দেয়ার সময় পায়নি। শত্রুরা সবাই স্পীডবোট ছেড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়। ১৪ জন শত্রুসেনার সবাই মারা যায়। আমি দেখি একজন শত্রুসেনা পানি থেকে আবার স্পীডবোটে ওঠার চেষ্টা করছে, সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে তার সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। এটা এক সাফল্যজনক অপারেশন ছিল। আমরা দুটি এম-জি-আর-এ-৩, ১টা চাইনিজ রাইফেল, ২টা চাইনজ স্টেনগান ১টা সমগ্র এলাকার আর্টিলারি ম্যাপ, ২টা পি-আর-সি, ১০টা অয়্যারলেস সেট এবং কিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করি। আমরা দেখি একটা স্পীডবোটে একজন মৃত পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন পড়ে আছে। আমরা তার ব্যাজটি ছিড়ে নেই আমরা দ্রুত অবসহান তুলে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পে দুপুর তিনটার সময় নিরাপদে পৌঁছি। পরে এক অফিসারের কাছ থেকে জানতে পারি (তিনি অয়্যারলেসের সাহায্যে পাকিস্তানের এ ঘটনার ম্যাসেজ ধরেন) স্পীডবোটগুলিতে ৩৩ বালুচর ৫ জন অফিসার এবং অন্যান্য র‍্যাঙ্কের ৯ জন ছিল। এদের মধ্যে ১জন লেঃ কর্নেল, ১ জন মেজর, ১জন ক্যাপ্টেন ডাক্তার, ১ জন আর্টিলারি ক্যাপ্টেন, একজন লেফটেন্যাণ্ট ছিলেন। এরা সবাই কুমিল্লা টাউনে বাঙালিদের উপরে আত্যাচার চালিয়েছিল, মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিল এবং ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। পরে স্থানীয় রাজাকার ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে মৃতদেহগুলি নিয়ে শত্রুরা কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টর সৈন্যদের কবরস্থানে কবর দিয়েছিল। এদের মধ্যে কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বোখারিও ছিল।

 মুক্ত এলাকায় আমার যে অবস্থানগুলি ছিল সে গুলি হচ্ছে বায়েক গ্রাম, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর, মঈনপুর, গোবিন্দপুর এবং জাদিশ্বর। শত্রুদের ঘাঁটি ছিল আমার এলাকার বিপরীতে কসবা, চাঁদলা, বড়ধুসিয়া, শালদা নদী রেলওয়ে স্টিশন ও নয়নপুর বাজারে। এসব এরাকা থেকে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর প্রায়ই গোলাগুলি চালাত। ছোট ছোট আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ,এ্যামবুশ ও রেইড দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। এতে শত্রুদের যথেষ্ট হতাহত হয়। আমাদেরও বেশ হতাহত হয়।

 শত্রুসেনারা রাজাকারদের কোম্পানীগঞ্জ-কুটি প্রধান রাস্তায় পাহারায় মোতায়েন রাখে। রাজাকারের একটি দল আমার সাথে গোপনে যোগাযোগ করে। তারা জানায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হলে তারা আমার নিকট আত্মসমর্পণ করবে এবং অনুমতি দিলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে। কোম্পানীগঞ্জ-কুটি সড়কের মধ্যে কালামোরায় ১০৩ ফুট লম্বা ১টা ব্রীজ ছিল। রাজাকাররা সে ব্রীজ পাহারা দিত। আমি আমার এক দূতের মাধ্যমে জানাই তাদেরকে হত্যা করা হবে না এবং প্রয়োজন হলে মুক্তিবাহিনীতে নেয়া হবে। তাদের আরো জানাই কালামোরা ব্রীজ উড়ানোতে তাদের সাহায্যেও প্রয়োজন হবে।

 আগস্ট মাসের এক রাতে ব্রীজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে ব্যস্ত রাখার জন্য সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে ৫ টি এ্যাম্বুশ দল পাঁচ জায়গায় প্রেরণ করি। রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত তারা শত্রুদের অবস্থানগুলি যথা সাহেবপারা, শালদা নদী গোডাউন, চাঁদলা প্রভৃতি জায়গায় শত্রুদের হঠাৎ করে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত রাখে। আর এদিকে পরিকল্পনা মত ই-পি-আর-এর সুবেদার আম্বিয়ার নেতৃত্বে একটি প্লাটুন কালামোরা ব্রীজে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রাত দুটার সময় ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়। এ কাজে রাজাকাররা আমাদের সাহায্য করে। ৭ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তারা আমার সাথেই ছিল।

 শত্রুরা রসদ সরবরাহ করার জন্য এ রাস্তা দিয়ে যাবে আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। সে জন্য এ কালামোরা ব্রীজ থেকে ১০০ গজ দূরে কোম্পানীঞ্জের দিকে এ্যামবুশ পেতে বসে থাকি। ভোরের দিকে শত্রুদের রসদ সরবরাহকারী দুটো সৈন্যবোঝাই জীপ, দুটো ডজ, ৩টা বেসরকারী গাড়ি, একটা বাস ও দুটা তিন টনের গাড়ি এ রাস্তা দিয়ে আসছিল। ব্রীজের কাছে এসে তা ভাঙ্গা দেখে তারা আবার ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হবার আমরা আকস্মাৎ রকেট লাঞ্চার, রাইফেল ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে শত্রুদের উপর