পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
164

বিপর্যয়ের কথা জানায়। আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে তার প্লাটুন নিয়ে শত্রুদের ধাওয়ার জন্য। সে আমার কথামত তাঁর প্লাটুন নিয়ে শত্রুদের ধাওয়া করে। ফলে শত্রুরা সেখানে নায়েব সুবেদার মঈনকে হাত পা বাধা অবস্থায় মেরে ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা তাকে মুক্ত এলাকায় এনে সামরিক কায়দায় সম্মান জানিয়ে সমাহিত করি।

 নায়েব সুবেদার মঈন একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তাকে যে কাজ দেয়া হত, সে কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতো। কোন নির্দেশ পাওয়ার পর, সে সেটা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত শাস্তি পেতনা। অসমসাহসী এ যোদ্ধার কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তার জন্য বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। মন্দভাগ গ্রাম ও রেলওয়ে স্টেশন আমাদের নিয়ন্ত্রনে অনেক আগে থেকেই ছিল। মন্দভগের পর শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকেই কুমিল্লা-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা-সিলেট ও কুমিল্লা-ঢাকা রেলপথে যেতে হয়। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন ও বাজার ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা। ব্রাক্ষণবাড়িয়া, বুরিচং, কসরা এলাকায় শালদা নদী গ্রামের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। ফলে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন ও গ্রামের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেক্টর-২ এর কমাণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমাকে শালদা নদী সাবসেক্টরের কমাণ্ডার মেজর সালেক চৌধুরী ক্যাপ্টেন পাশা ও ক্যাপ্টেন আশরাকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে আমার হেডকোয়ার্টারে এক আলোচনা সভা ডাকেন। তিনি আমাদের বলেন, আমরা মন্দভাগ মুক্ত করেছি। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন মুক্ত করতে পারলে আমাদের মুক্ত করতে পারলে আমাদের মুক্ত এলাকা বেড়ে যাবে এবং সামরিক ও অন্যান্য দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি যুক্ত করতে পারলে শত্রুদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। সে মতে তিনি আমাদের শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন মুক্ত করার জন্য শত্রুদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা চালাবার নিদের্শ দেন এবং তিনি নিজে এ আক্রমণ পরিচালনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আমার একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর দিকে বায়েক গ্রামে অবস্থান নেই। ক্যাপ্টেন আশারাফ একটা কোম্পানী নিয়ে মন্দভাগ গ্রাম থেকে এগিয়ে শত্রুদের নয়নপুর ঘাঁটির কিছু দূরে অবস্থান নেন। মেজর সালেক খাল পার হয়ে শালদা নদী পার হয়ে একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদী স্টেশনের পশ্চিমে শালদা নদী গোডাউনে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন পাশা বাংলাদেশের প্রথম আর্টিলারী বাহিনী নিয়ে আমার অবস্থানের পিছনে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান নেন। আআদের সাহায্য করার জন্য সুবেদার জববার তার মর্টার সেকশন নিয়ে আমার অবস্থানের পিছনে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৬টার সময় গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন পাশা প্রথম পাক অবস্থানের উপর গোলা ছুড়তে থাকে। মেজর সালেক, আশরাফ এবং আমি নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে শত্রুদের অবস্থানের উপর নির্দিষ্ট সময়ে হামলা চালাই। শত্রুরা তাদের গোলন্দাজ ঘাঁটি বুড়িচং, কসবা, কুটি, চাঁদলা থেকে আমাদের উপর অবিরাম গোলাবষর্ণ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন আশরাফের আক্রমনে নয়নপুর গ্রামে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর গ্রাম ছেড়ে শালদা নদীদক্ষিণ পাড়ে চলে যায়। নয়নপুর গ্রাম আমাদের দখলে চলে আসে। আমি আমার বাহিনী নিয়ে নয়নপুর গ্রামের রেলব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে যাই। মেজর সালেক শালদা নদী বাজার এবং গোডাউন দখল করে নেয়। শালদা নদীর দক্ষিণ পার্শ্বের বিলে শত্রুদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য মেজর সালেক শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এগুতে পারেননি। এ যুদ্ধ চলে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। শত্রুরা তাদের তিনটি গোলন্দাজ ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থান ও মুক্ত এলাকাতে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদেও গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাবার ফলে মেজর সালেক তার অগ্রবর্তী অবস্থান তুলে নিয়ে মন্দভাগে চজলে আসেন। ক্যাপ্টেন আশরাফ এবং আমার দখলকৃত জায়গা আমার দখলে রাখি। মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফ তাদের বাহিনী আমার অধীনে রেখে ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে চলে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের নামকরা সাতারু হাবিলদার সিরাজসহ ৬জন সৈন্য পাকিস্তানী গোলাগুলির ফলে নিহত এবং আহত হয়। শত্রুদের হতাহতের সঠিক কোন খবর না পাওয়া গেলেও লোকমুখে আমরা জানতে পেরেছি নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে ট্রলিযোগে অনেক আহত এবং নিহত