পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
165

সৈনিকদের কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে গেছে। এটাই ছিল প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর পর আমরা শত্রুদের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করার পথ বেছে নেই। সৈন্য এবং গণবাহিনীর ছেলেদেও মনোবল এ যুদ্ধের পর বেড়ে যায়। গণবাহিনীর ছেলেরা যদিও এই সামনাসামনি যুদ্ধে কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু পরে তারা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এ যুদ্ধের পরেই মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফের কাছ থেকে শালদা নদী সাব-সেক্টরের ভার নিয়ে নেই। শেষ অবধি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত দুই সাবসেক্টর আমার অধীনেই ছিল। মেজর সালেক ছিলেন এক অসমসাহসী যোদ্ধা।

 মন্দভাগ ও শালদা নদী সাব-সেক্টরের মধ্যে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে শত্রুদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমি শালদা নদী সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন আশরাফ সেক্টর-২ এর কমাণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে যৌথভাবে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে শত্রুদের ঘাঁটির উপর পূর্বেই একবার হামলা চালিয়েছিলাম। কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও শত্রুদের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে বিতারিত করা সম্ভব হয়নি।

 এরপর মেজর সালেক শালদা নদী সাব-সেক্টরের ভার আমার হাতে ছেরে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। আমি চিন্তা করতে থাকি শত্রুদের কি করে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিতারিত করা যায়। সে উদ্দেশ্যে আমার মূল ঘাঁটি মন্দভাগ থেকে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটির অবস্থান পর্যবেক্ষন করার জন্য কালো শার্ট ও লুঙ্গি পড়ে কৃষকের বেশে শালদা নদীর রেলওয়ে স্টেশনের নদীর বিপরীত দিকে এক বিরাট নিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সময় ছিল ঠিক সন্ধার আগে। শত্রুরা আমাকে দেখতে পায় এবং আমার উপর গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। নিম গাছের সামনে আমাদের একটা পরিক্ষা ছিল।কিন্তু এত ক্লান্ত ছিলাম যে গাছ ছেড়ে পরিখায় নামতে পারিনি। গাছকে আরাল করে বসে থাকি। তাদের আমার পাশ দিয়ে চলে যেতে থাকে। সন্ধার পর গোলাগুলি বন্ধ হলে আমি আমার ঘাঁটিতে ফিরে আসি।

 শত্রুদের প্রতিরক্ষা অবস্থান পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারি শত্রুদের অবস্থান খুবই শক্তিশালী। নদীর তীর বরাবর আমাদের অবস্থানের সামনে তারা চারটি বড় পরিখা খনন করেছে। শালদা নদী গোডাউনের পাশ দিয়েও তারা এরকম শক্তিশালী পরীখা খনন করেছে। এ অবস্থানে আমি শত্রুদের কাবু করার জন্য তিন দিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমনের পরিকল্পনা নেই এবং নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বে পাহাড়ী জায়গায় একটা প্লাটুন পাঠাই। সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে আর একটা প্লাটুন নিয়ে শালদা নদী গোডাউনের নিকটে গিয়ে অবস্থান নিতে বলি। সুবেদার বেলায়েতকে নিয়ে আর একটা প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীতে শত্রুদের ঘাঁটির নদীর বিপরীতে অবস্থান নিতে বলি। আমাদের যাতে শত্রুরা পিছন থেকে আক্রমন করতে না পারে তার জন্য সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে একটা কোম্পানীকে সুবেদার মঙ্গল মিয়ার পিছনে অবস্থান নিতে বলি। সঙ্গে সঙ্গে চারটা রেইডিং পার্টিকে শত্রুদের অন্যান্য অবস্থান যথা বড়ধূসিয়া, চাঁদলা, সাহেববাড়ি, গোবিন্দপুর ও কায়েমপুরের আগের ঘাঁটিতে রাতে হঠাৎ রেইড করার নির্দেশ দেই। হঠাৎ করে চারটা ঘাঁটিতে আক্রমনের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম এ জন্য যে, এর ফলে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে। অবস্থানরত শত্রুদের দৃষ্টি অন্যদিকে পড়বে। হঠাৎ করে চারটি ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে তাদের ঐ চারটা অবস্থানকে রক্ষার জন্য তারা মর্টার ও কামানের গোলা আমাদের উপর নিক্ষেপ করবে। এভাবে তাদের মর্টার ও কামানের গোলা অনেক শেষ হয়ে যাবে। পরিকল্পনা মত ৭/৮ই অক্টোবর রাতে ৪টি রেইডিং পার্টি ক্রমান্বয়ে বড়ধূসিয়া, চাঁদলা, কায়েমপুর ও সাহেববাড়ি গোবিন্দপুরে হামলা চালায়। এটা চলে সারারাত ধরে। শালদা রেলওয়ে স্টেশন থেকে শত্রুরা আমাদের এ্যামবুশ পার্টিগুলির উপর মর্টার ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ভোরের দিকে এ আক্রমন বন্ধ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শত্রুরা রাতে আমাদের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকত, কিন্তু দিনের বেলা তারা এতখানি প্রস্তুত থাকত না। সাধারনত দিনের বেলা ই-পি-সি-এ-এফ ও রাজাকারদের পাহারায় মোতায়েন করে তারা ঘুমাত, না হয় বিশ্রাম নিত।