পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
167

 শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল একটা সাহসী পরিকল্পনা ছিল। আমি অবশ্য আশান্বিত ছিলাম যদি তাদের ঠিকমত আঘাত করা যায় এবং মনোবল ভেঙ্গে দেয়া যায়,তবে নিশ্চয়ই জিতব। এটা অত্যন্ত শক্ত এবং দুঃসাহসী কাজ ছিল।

 শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল করার পর আমরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সেখানে পাই। ২১টা ৩০৩ রাইফেল, ৫টা হালকা মেশিনগান, এম-জি-আই-এ-৩ ৩ টা ম্যাগাজিন বক্স ২টা, হালকা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৩১টা, বেটাগান ২টা, রকেট লাঞ্চার ৪০-এম এম ১টা, অয়্যারলেস সেট পি-আর-সি-৬২ একটা, হারিকেন ৪টা, গোলাবারুদ ২০, ২৫০টা, ২ ইঞ্চি মর্টার বোমা ২০০টা, ৬০-এম-এম মর্টার বোমা ৭২টা, ৩০৩ বল ১০ হাজার, ২ ইঞ্চি মর্টার বোমা ধোঁয়া ৪টা, টেলিফোন সেট ৩টা, জেনারেটর ১টা, পি-আর-সি-১০ অয়্যারলেস সেট ব্যাটারিসহ ৫টা, ট্রানজিস্টর ৩ ব্যাণ্ড ১টা এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য রসদ ও অসংখ্য কাপর- চোপর। এছারাও ব্যারেল হোল্ডার ২টা, এম-জি স্পেয়ার ব্যারেল ২টা, ম্যাপ এবং বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র। এসব দলিলপত্র থেকে জানতে পারি যে ৩০ পাঞ্জাবের 'বি' এবং 'ডি' কোম্পানী আখানে মোতায়েন ছিল। এ লড়াই ভোর পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলে। প্রায় ১৬ ঘণ্টা ধরে দু'পক্ষে তুমুল লরাই চলে। এ যুদ্ধে আমার বাহিনীর ২ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। শত্রুদের প্রায় ১০০ জন নিহত এবং ধৃত হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে আমরা জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। শত্রুদের কতজন আহত হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও এটা নিশ্চিত যে তাদের অনেকেই আহত হয়েছিল।

 শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে কৃতিত্বের সঙ্গে লড়াই করে শত্রুদের বিতারিত করার জন্য তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর তরফ থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে আমাকে বীরত্বসূচক হাই অর্ডার (গ্যালানট্রি এওয়ার্ড) সম্মানে সম্মানিত করে। স্বাধীন হবার পর এর নাম দেয়া হয় বীরউত্তম। এ ছিল আমার সাবসেক্টরে কৃতিত্বপূর্ণ লড়ায়ের একটি পুরস্কার।

 মন্দভাগ শালদা নদী সাবসেক্টরে যেসব সেনা শত্রুদের সাথে লড়ায়ে শহীদ হন, তাদের আমি কুলাপাতড়া নামক স্থানে সমাহিত করার ব্যাবস্থা করি। এদের স্মৃতিচিহ্ন এখনও কুলাপাতড়ায় বিরাজ করছে।

 শালদা নদী থেকে শত্রুরা পরাস্ত এবং বিতাড়িত হবার পর তারা বুড়িচং এবং কুমিল্লার দিকে সরে যায়। শালদা নদী মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনীর একটা কোম্পানী ফ্লাইং অফিসার কামালের অধীনে রাখা হয়। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম, এ, জি, ওসমানী (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) আমাকে ‘কে' ফোর্সের ৪র্থ বেঙ্গলকে নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। সেই মত আমি আমার বাহিনী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই। ফেনীতে অবস্থানরত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য আমি আমার বাহিনীকে ছাগলনাইয়া থেকে শুভপুর ব্রীজ পর্যন্ত শত্রুদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ঘিরে অবস্থান নেবার নির্দেশ দেই। সেই মত তারা অবস্থান নেয়। ' ফোর্সের ১০ম বেঙ্গলের অধীনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়া থেকে লক্ষীপুর পর্যন্ত অবস্থান নেয়। ভারতীয় বাহিনীর দুটো ব্যাটালিয়ান আমাদের সাহায্য করার জন্য বিলোনিয়াতে অবস্থান নেয়। আমরা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে অবস্থান শক্তিশালী শত্রুদের উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে গোলা চালাতে থাকি। শত্রুরা এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। শত্রুদের মনোবল তখন একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। শত্রুরা আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে ভীত হয়ে ৬ই ডিসেম্বর ফেনীতে তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে শুভপুর ব্রীজ হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর ফেনী শত্রুমুক্ত হয়। ফেনীতে আমরা অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। শত্রুরা শুভপুর হয়ে চট্টগ্রামে পালাবার সময় রেলব্রীজ ও শুভপুর সড়কসেতু দুটোই ধ্বংস করে দিয়ে যায়। আমরা ফেনী দখল করার পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করি। কিন্তু শুভপুরের পারাপারে দুবার দুটো ব্রীজই ধ্বংস হবার ফলে আমাদের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমরা শুভপুরে ব্রীজ মেরামতের জন্য দু'দিন অবস্থান করি।ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা দু'দিনের ব্রীজ পুনঃনির্মাণ করে। তারপর আমরা নৌকা করে এবং ব্রীজের সাহায্যে শুভপুর পার হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হই। করেরহাটে রাত ৮টার সময় “কে” ফোর্সের