ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাক, মুক্তিযোদ্ধা কাদের, মোজাম্মেল, ফিরোজ, মিজানুর, মোশাররফ, রবিউল ও আরো অনেকে। কর্নেল খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেক্টর-২-এর অধিনায়ক। তিনি অনেক সময় আমাকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। সুবেদার বেলায়েত, সুবেদার মঈন বীরত্বের সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হন। তাদের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। এ সমস্ত ব্যক্তির সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে আমার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হতো না মন্দভাগ ও শালদা নদীতে শত্রুদের পর্যুদস্ত ও পরাজিত করতে। মনে পরে আরেকজন স্থানীয় ডাক্তার জনাব জহুরুল হকের কথা- যিনি সব সময় আমার আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করে ছিলেন। আরো মনে পরে শালদা নদী, মন্দভাগের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য-সহযোগিতার কথা। তারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, অনেক সময় খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন, শত্রুদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন এবং গোলার মুখে পড়েও তারা কোনদিন ভীত হননি। আমি এদের সবাইকে আমার কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের সাথী হিসেবে মনে করি। এদের সকলের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল শত্রুদের বিতাড়িত ও পর্যুদস্ত করা। আমি তাদের সবাইকে স্মরন করি এবং কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য সালাম জানাই।
সাক্ষাৎকারঃ মেজর ইমামুজ্জামান[১]
জুন মাসের ৭ তারিখে পাকিস্তানীরা প্রথমবারের মত ফেনী থেকে পরশুরামের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করা হয়। তাদের প্রায় ৩০০ জনের মত নিহত হয়। লাশগুলো এ্যামবুলেন্সে করে নিয়ে যাবার সময় আমরা দেখতে পাই।
জুন মাসের ২১ তারিখের মধ্যে ওরা ১৭ বার আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রতিবারই ওদের আক্রমণকে প্রতিহত করা হয়। ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। জুন মাসের ২১ তারিখে ৭টা হেলিকপ্টার (সৈন্য বোঝাই) আমাদের পিছনে নামানো হয়। ভোর তিনটা/চারটার দিকে পেছনের এক ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডো সৈন্যএবং সামনে থেকে আক ব্রিগেডেরও অধিক সৈন্য ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের বহু লোক হতাহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে মুহুরী নদীর পার ঘেঁষে ঘেঁষে ওদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেতর দিয়ে বহু কষ্টে বের হয়ে আসলাম, আমাদের অনেকে হতাহত হয়েছিল। বেলুনিয়া পর্যন্ত ওরা আমাদের পিছু ধাওয়া করে। আমরা বেলুনিয়া চলে যেতে বাধ্য হই।
চৌদ্দগ্রামের সীমান্তে ক্যাম্প খুললাম। সেখান থেকে গেরিলা অপারেশন শুরু করা হয়। লাকসাম থেকে ফেনী রেলওয়ে লাইন এবং লাকসাম-চাঁদপুর রেলওয়ে লাইন এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য রাস্তার উপর মাইন পুঁতে রাখি। এসময় ডিনামাইট দিয়ে অনেক গাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়। সৈন্য বোঝাই অনেক ট্রেনের ক্ষতি সাধন করা হয়। জগন্নাথদিঘী, চিওড়া, চৌদ্দগ্রম হরিসর্দার বাজারে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলোতে রেইড করা হয়।
অক্টোবর মাসে আমার কোম্পানী এবং মেজর জাফর ইমামের কোম্পানী নিয়ে দ্বাদশ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট গঠন করা হয়। নভেম্বর মাসের ২ তারিখে দ্বাদশ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পেছন থেকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় পরশুরামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। সকালের মধ্যেই ৪ বর্গমাইল এলাকা আমরা মুক্ত করতে সক্ষম হই। ৪৪জন সৈন্য একজন ক্যাপ্টেনসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
- ↑ লেঃ কর্নেল ইমামুজ্জামান ১৯৭১ সালের মার্চে লেফটেন্যাণ্ট হিসাবে কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন। ইমামুজ্জামানের এ সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়।