পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
176

তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনা করি। তখন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়। আমাদের নির্দেশ ছিল হঠাৎ করে আক্রমণ করো এবং সরে এসো। আমরা দু'দলে বিভক্ত হয়ে একদলকে রক্ষণভাবে রাখি। দ্বিতীয় দল মর্টারের সাহায্যে পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন গফফারের সাথে মর্টারের শেলিং-এ। শেলিং করে আমরা চলে আসি। চলে আসার সময় পাকসেনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালায়। আমরা সবাই ক্যাম্পে ফিরে আসি। পরে খবর পেয়েছিলাম ওদের ১৫ জনের মত মারা গিয়েছিল এবং প্রচুর গোলাবারুদের ক্ষতি হয়েছিল। এটাই ছিল আমার প্রথম অপারেশন। ক্যাম্পে সমস্ত সৈনিকদের দেখি শত্রু খতম বা আক্রমণের এক নেশার মধ্যে আছে। খাওয়া- দাওয়ার অনিয়ম বা কাপড়-চোপড়ের অভাব তাদের ছিল, কিন্তু এদিকে কারও খেয়াল ছিল না। শত্রুর খোঁজ পেলে তারা তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করার আনন্দে মেতে উঠত। তাদের দেশপ্রেম এত প্রবল হয়ে উঠছিল যে, মৃত্যুভয়ও তাদের টলাতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও এই নেশায় পেয়ে বসল। এরপর যখন কোন খবর পেতাম শত্রুকে আক্রমণ করার, তখন আমি আমার অধীনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গিয়ে পেট্রোলিং এ্যামবুশ এবং শত্রুর ওপর হঠাৎ আক্রমণ চলাতাম। এরপর ক্যাপ্টেন গফ্ফার আমার অধিনায়কত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি দিলেন।

 কসবা হচ্ছে এমন একটি স্থান যার ভৌগলিক গুরুত্ব অপরিসীম। কসবা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভারতীয় সীমান্ত দেখা যায়। সীমান্তের পাশ দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়। পাহাড়ে বেশ গাছপালাও আছে। মে মাসের ২২/২৩ তারিখের দিকে খবর পেলাম পাকসেনারা দুটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র মন্দভাগ রেলওয়ে (কসবার নিকট) স্টেশন থেকে শালদা নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ে ট্রলির দুই পাশ দিয়ে আক প্লাটুন পাকিস্তানী সেনা টহল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে দু সেকশন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি খালি গায়ে এবং লুঙ্গি পরা অবস্থায় পাহাড়ের ধার দিয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হলাম। খালি গায়ে ছিলাম এই জন্য যে, গেঞ্জি বা কোন কিছু পরে থাকলে তাদের নজর পড়ে যেতে পারে। আমরা সকাল ৯টায় এসে মন্দভাগ গ্রামে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এ্যামবুশ পেতে বসে থাকলাম। আধঘণ্টা পরেই দেখলাম সেনাবাহিনীর লোকেরা ট্রলির দু'পাশ দিয়ে হেঁটে পাহারা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রলি দু'টি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। আমরা হঠাৎ করে এলএমজি, এসএমজি'র সাহায্যে শত্রুদের উপর অতর্কিত গুলি ছুড়তে লাগলাম। কয়েকজন পাকসেনা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনারা ট্রলির ওপাশে গিয়ে পজিশন নিয়ে আমাদের ওপর গোলাগুলি ছুড়তে লাগল। আমরা রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে ট্রলির উপর আঘাত হানলাম। এক্সপ্লোসিভ থাকায় লাঞ্চারের আঘাতে ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট করে দেয়া হয়। তারপর পাকসেনা আর্টিলারীর সাহায্যে আমাদের উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করে তাদের আহত জোয়ানদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার পর আমি আমার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। দেখি ভাঙ্গাচোরা অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। এরমধ্যে কিছু ভাল অস্ত্র ছিল। আমরা ঐ সমস্ত অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসি। এ এক দুঃসাহসিক অভিযান ছিল, যা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। উল্লেখযোগ্য যে, আমার বাহিনীর কেউ এ অপারেশনে মারা যায়নি। কসবা থেকে মন্দভাগ রেলওয়ের দূরত্ব মাত্র দু'মাইল।

 এরপর অনেক ছোট খাটো অপারেশন করেছি যা আজ আর মনে নাই। তবে প্রায়ই অপারেশন করতাম।

 জুন মাসের ৮ তারিখে ক্যাপ্টেন গফফার এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বেলুনিয়া ক্যাম্পে চলে গেলেন। কসবা সাব-সেক্টরের ভার আমার উপরে পড়ল। আমার অধীনে এক কোম্পানীর বেশী মুক্তিযোদ্ধা রইল।

 তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যাণ্ট জেনারেল টিক্কা খান ঘোষনা করলেন- ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন পুনরায় চালু করা হবে। ট্রেন মোটামুটি ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনের অন্য জায়গায় চললেও আখাউড়া থেকে শালদা নদী পর্যন্ত কোন ট্রেন চলতো না। ঐ জায়গার গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। টিক্কা খানের এ ঘোষণা শুনে সেক্টর-২-এর কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ একদিন মেলাঘরে (সেক্টর-২-এর হেডকোয়ার্টার) সাব-সেক্টর