পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
178

অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়া হতো। একবার এক মুক্তিযোদ্ধা গ্রামে গিয়ে ডাকাতি করেছে। এ খবর শোনার পর তা পরীক্ষা করে সত্য প্রমাণিত হওয়ায় তাকে শাস্তি প্রদান করি। এ ব্যাপারে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হত না।

সংগ্রামের এক প্রান্তরঃ মেজর জাফর ইমাম

। বিচিত্রা : ৮ ফেব্রুয়ারী ও ৩০ মার্চ ১৯৭৩৷

 ৬ই নভেম্বর হেডকোয়ার্টার আমাকে ডেকে পাঠালেন। তখন বেলুনিয়া পকেটটি পুরোপুরি পাকবাহিনীর দখলে ছিল।

 আমাকে ডেকে বলা হলো, বেলুনিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে ফেনী পর্যন্ত এই পকেটটি যুক্ত করার ভার তোমার উপর দেওয়া হলো। পরশুরাম, চিতলিয়া, ফুলগাজী, বেলুনিয়া ও ফেনী এই বিশেষ স্থানগুলো তখন ছিল পাকবাহিনীর মজবুত ঘাঁটি। আমি এ জায়গাগুলো থেকে শত্রুদের পুরোপুরি বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিলাম। এই সংকল্পকে বাস্তবায়িত করার কাজ হতে নিলাম ৮ই নভেম্বর। এই দিনটি ছিল আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। ১০ম বেঙ্গল ও ২য় বেঙ্গলের একটি কোম্পানীর সাথে গভীর আত্মবিশ্বাস ও অসীম মনোবল নিয়ে আমি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দলটি ছিল ক্যাপ্টেন মোরশেদের অধীনে।

 পরশুরাম ও বেলুনিয়ার পকেট থেকে শত্রুদের হটানোর ব্যাপারে মিত্র বাহিনীর জেনারেল হীরা আমায় চ্যালেঞ্জ করলো। আমি দৃঢ়ভাবে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম এবং অতি সুনিপুণভাবে এ অভিযানকে সফল করে তুলবোই। তাই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সামরিক কৌশলের অন্যতম কৌশল হিসাবে গোপন অনুপ্রবেশ দ্বারা শত্রুদের গোপনে অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, আমরা যে বাহিনী দ্বারা এ অভিযান শুরু করেছিলাম তারা পুরোপুরি সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এই অভিযানে ১০ বেঙ্গল ও ২য় বেঙ্গলের শতকরা ৮০ জন সৈন্য ছিল পুরনো বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এবং বাকী শতকরা ২০ জন সদস্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তাছাড়া মিত্র বাহিনী আমাদের এ অভিযানে অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। রাতের অন্ধকারেই আমরা গোপন অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করবো বলে সাব্যস্ত করলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রাতের মধ্যেই অনুপ্রবেশের কাজ শেষ করে ভোর হবার আগেই ওদের সাথে মোকাবিলা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া।

 নভেম্বর অন্ধকার শীতের রাত। টিপ টিপ করে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। হিমেল হাওয়ায় গাছের পাতায় যেন একটি অশরীরি শব্দ সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল সমস্ত রাতটা যেন কিছুর প্রতীক্ষায় আছে। রাত আনুমানিক ১০-৩০ মিনিট। আমাদের অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করলাম। আমরা এমন একটা এলাকা ঘেরাও করার অভিযানে নেমেছি যার তিনটা দিকই ছিল ভারত সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। আমরা এই ভারতের এক প্রান্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম চিতলিয়ার মাঝ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ভারত সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের এই অবরোধ যদি সফল হয় তবে শত্রুরা সহজেই ফাঁদে আটকা পড়বে।

 অবরোধের কাজ শুরু হলো। অন্ধকার রাতে মুহুরী নদী ও চিলনিয়া নদীর কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বা পিচ্ছিল রাস্তার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি সবাই। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অন্ধকার রাত। সামান্য কাছের লোককেও ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। কমাণ্ডার হিসেবে সবাইকে সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করে আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সত্যই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও সব বাধাকে তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চললাম এবং সাথে সাথে আমি আমার দলের অন্যান্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চললাম। নিঃশব্দ হয়ে সবাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছি। কারো মুখে কোন কথা নাই। শত্রুরা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারলো না যে ওদের জালে আটকাবার জন্য আমরা এগিয়ে আসছি। শত্রুরা