পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
179

যদি আমাদের এ অনুপ্রবেশ টের পায় তবে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র গোপন অনুপ্রবেশ যদি অপর পক্ষ টের পায় তবে পরিকল্পিত অভিযান সফল করা সম্ভব হয় না। আমরা আরো অনেক পথ এগিয়ে এলাম। আমাদের এ কাজে বেশ সময় লাগছিল। কারণ অন্ধকার রাতে নির্ভুল পথে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। এছাড়া আরো একটা ভয়ের সম্ভাবনা ছিল। শত্রুদের লোকেরা রাতে বিভিন্ন জায়গায় পেট্রোলিং-এ ছিল। তাদের খপ্পরে পড়াও বিচিত্র ছিল না। সে ভয় আমাদের অমূলক ছিল না। আমরা যখন রেলওয়ে ও কাঁচা রাস্তার কাছাকাছি এগিয়ে এলাম তক্ষুণি দেখলাম শত্রুপক্ষের ডিউটিরত একটি দল রেললাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা টুপ করে লুকিয়ে গেলাম- কেউ বা রাস্তার আড়ালে, কেউ বা জমিনের আড়ালে। ওরা কিছুই টের পেল না। নিশ্চিত মনে গল্প করতে করতে চলে গেল। বিপদ কেটে গেল। এদিকে রাত বাড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার কোম্পানীর কমাণ্ডারদের সাথে যোগাযোগ করলাম। ওরা জানালো সব ঠিক আছে। ওরা নিরাপদেই অবরোধের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভোর হবার বেশ বাকী নেই। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে হাজির হলাম এবং এর ফলে শত্রুদের পরশুরাম ও চিতলিয়া ঘাঁটি পুরোপুরি আমাদের অবরোধের মাঝে আটকা পড়লো।

 আমরা শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে যাতে কোন প্রকার আক্রমণ না আসতে পারে তার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। ভোর হয়ে আসছিল। আমরা প্রতিরোধের সকল ব্যবস্থা শেষ করতে লাগলাম। বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ শুরু হলো। এবং অন্যান্য সব ব্যবস্থাও করতে লাগলাম। পথশ্রমে ও ক্ষুধার তাড়নায় সবাই ক্লান্ত। তবুও বিশ্রামের সময় নেই। ভোরের আলো ফুটবার আগেই প্রতিরোধের কাজ শেষ করতে হবে, তাই প্রাণপণে সবাই কাজ করতে লাগলাম। ভোর হলো। আমরাও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুরা আমাদের অবরোধের মাঝে। এ সফলতার খবরটা জেনারেল হীরাকে জানাতে ইচ্ছে হলো। ওয়ারলেসে হীরাকে জানালাম যে শত্রুদের আমরা পুরোপুরি জালে আটকিয়েছি। খবরটা শুনে জেনারেল হীরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। ধন্যবাদ দেবার সময় খুশিতে তার বার বার কথা আটকে যাচ্ছিল। আমি আমার চ্যালেঞ্জে জিতেছি বলে জেঃ হীরা ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানালো। এদিকে ভোরের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। ভোরের আলোয় চারিদিকে ভাল করে দেখতে লাগলাম। তারপর বুঝতে চেষ্টা করলাম যে শত্রুরা আমাদের অনুপ্রবেশ টের পেয়েছে কিনা। কিন্তু না। তা বোঝার কোন উপায় নেই। চারিদিক নীরব। কোথাও মানুষের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

 বেলুনিয়া থেকে রেললাইনের সাথে সমান্তরালভাবে কাঁচা রাস্তাও চলে এসেছে ফেনী পর্যন্ত। এই রাস্তার পাশেও আমাদের বেশকিছু বাঙ্কার গড়ে উঠেছে। বাঙ্কারে বসে সবাই সামনের দিকে চেয়ে আছি। বেশ কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎ দূর থেকে একটা ট্রলির আওয়াজ অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। শব্দটা চিতলিয়ার দিক থেকে থেকেই আসছে বলে মনে হলো। রেললাইন ও রোডের কাছের বাঙ্কারে যারা ডিউটিতে ছিল তাদের মধ্যে নায়েব সুবেদার এয়ার আহমদ ছিল খুবই সাহসী। যুদ্ধের প্রথম থেকেই সে আমার সাথে থেকে নির্ভীকতার সঙ্গে লড়াই করে আসছিল।

 ট্রলিটা এগিয়ে আসছে। সবাই প্রতীক্ষায় বসে রইল। আস্তে আস্তে ট্রলির শব্দটা আরো কাছে এগিয়ে আসছে। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম কয়েকজন সৈন্য বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা নিশ্চিত মনে আসছে। ওরা বুঝতেও পারেনি ওদের শত্রুএত কাছে রয়েছে।

 এক, দুই, তিন...মিনিটের কাঁটা ঘুরতে লাগল। ট্রলিটা একেবারে কাছে এসে গেলো। এয়ার আহমদ ও তার সঙ্গীদের হাতের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। অনবরত ফায়ারিং-এর শব্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠলো। শত্রুরা অনেকেই পালাতে চাইলো কিন্তু তা সম্ভব হতে আমরা দিলাম না। একজন শত্রুন্ত প্রাণে বাঁচতে পারলো না। আনন্দে এয়ার আহমেদ ও তার সঙ্গীরা ‘জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। উত্তেজনায় আনন্দে ওদের সারা শরীর কাঁপছিল।