পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
181

করতে লাগলাম। যেহেতু ওরা জানতো আমাদের কোন বিমান বিধ্বংসী কামান নেই, তাই নিশ্চিত হয়ে নিচু দিয়ে বিমান চালাচ্ছিল।

 সবাই অপেক্ষায় আছি। কখন আমাদের এমএমজি'র আওতায় বিমানগুলো আসে। আর দেরী হলো না। এমএমজি'র আওতায় এসে গেল বিমানগুলো। মুহূর্তে গর্জে উঠলো এমএমজি। দুটি বিমান উড়ে চলে গেল ওদের সীমানায়। আর একটি ফিরে যেতে পারলো না। শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়লো মাটিতে। জোয়ানরা চেঁচিয়ে উঠলো উল্লাসে। সেদিন ছিল নিঃসন্দেহে ১০ম ও ২য় বেঙ্গলের সংগ্রামী দিনগুলোর একটি স্মরণীয় দিন। কোন যুদ্ধের ইতিহাসে হয়তো বা এর আগে এমএমজি দিয়ে কোন বিমানকে ভূপাতিত করা হয়নি-আমরা তাই করতে পেরেছি। গর্বে সবার বুক ভরে উঠলো। এই কৃতিত্বপূর্ণ ঘটনাটা সে এলাকার জনসাধারণের মনে রেখাপাত করেছিল বেশী। তাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো এ কথা। আমাদের জন্য ওরাও যেন গর্বিত।

 সেদিনই মিত্রবাহিনীর জেনারেল হীরা অয়ারলেসে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। সেদিন রাতে আমরা মিত্রবাহিনীর সক্রিয় ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় শত্রুদের বেলুনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালাম। ওরা আমাদের হামলার মুখে বেশীক্ষণ টিকতে পারলো না। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওরা। শত্রুদের শতকরা ৮০ ভাগ সৈন্যই আমাদের আক্রমণে প্রাণ দিল। রাতের মধ্যেই আমরা পরশুরাম ও বেলুনিয়া দখল করতে সক্ষম হলাম।

 অভাবর্ণীয় ও অবর্ণনীয় এক দৃশ্য দেখলাম ওদের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে গিয়ে। চারিদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। ধানক্ষেতে, বাঙ্কারে, বাঙ্কারের অদূরে খালের পানিতে কোথাও ফাঁক নেই। যারা আহত হয়েও পালাতে চেয়েছিল তারা শরীরের অসমর্থতার জন্য পারেনি। অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছিল বাঁচার আশায়। আহত এসব সৈন্যদের চিকিৎসা করা আমাদের কর্তব্য- তাড়াতাড়ি তার ব্যবস্থা করতে বললাম, কিন্তু ওদের মাঝে বেশীর ভাগ সৈন্য মারা গেল। মাত্র ৩/৪ জন বাচঁতে পারলো। আমরা সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ ৪৯ জনকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাদের সাথে এদেরও বন্দী করা হলো।

 পরশুরাম ও বেলুনিয়া ঘাঁটির এ মর্মান্তিক পরিণতিতে শত্রুরা ভেঙ্গে পড়লো। চিতলিয়া ঘাঁটির শত্রুরা মনে হলো এতে ভয়ানক নিরাশ হয়ে পড়লো। ওরা পালিয়ে গেল মুন্সীরহাটে।

 আমরা আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে আসতে লাগলাম এবং ওদের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝে আরো কিছু কায়দা বের করতে চাইলাম। এবারে আমরা অবস্থা বুঝে পুরনো কায়দা হিসেবে গোপন অনুপ্রবেশ করার পরিকল্পনা নিলাম। আমরা নীলক্ষেতে ঘাঁটি করে ওদর ফুলগাজী ঘাঁটির উপর চাপ সৃষ্টি করবো- যাতে ওরা দুর্বল হয়ে পালাতে বাধ্য হবে হয়তো। নীলক্ষেতে আমরা মজবুত ঘাঁটি করে বসলাম। ওরা আমাদের পরিকল্পনাটা টের পেল মনে হয়। তাই তারা চিতলিয়ার ঘাঁটি ছেড়ে সবাই ফুলগাজীতে এসে মিললো। আমরা তখন সরাসরি ফুলগাজীর উপর চাপ সৃষ্টি করলাম। ওরা অবস্থা বুঝতে পারলো। ব্যাপার সুবিধের নয় ওদের জন্য। ওরা একেবারে সব ঘাঁটি ছেড়ে বান্দুরা রেল স্টেশনের কাছে এসে ঘাঁটি স্থাপন করলো।

 আমরা আরো এগিয়ে আসলাম। কালিহাট ও পাঠাননগর থেকে আমরা শত্রুদের মুখোমুখি হয়ে ঘাঁটি স্থাপন করলাম। আমাদের দক্ষিণ দিকে ছিল সোনাগাজী। সেখানে আমরা আগেই গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে সব ঠিক করে রেখেছিলাম। ওরা এখন আমাদের দ্বারা তিনদিক দিয়েই চাপের ভিতর পড়েছে। তখন বাধ্য হয়ে সোনাগাজী দিয়ে পালাতে চাইবে, সেহেতু আমরা সে পথ ওদের জন্য ইচ্ছা করে মুক্ত রেখেছি আর গেরিলা বাহিনী রেখেছি গোপনে, যাতে তারা পালাতে গেলেই ওদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। ওরা আমাদের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ হয়ে লাকসামে চলে গেল এবং এতে ও ওদের অধিক সংখ্যক সেনাই পালাতে সক্ষম হলো।