পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
182

৬ই ডিসেম্বরে আমরা ফেনী মুক্ত করলাম। ফেনীর এতদিনকার গুমোট ও ধোঁয়াটে আকাশে স্বাধীনতার পতাকা উড়লো। অগণিত জনতার শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। দীর্ঘ ৯টি মাস পরে মুক্ত বাতাসে সবাই দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ফুলের মালা আর জনতার বরণডালার আতিশয্যে আমরা সেদিন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। দু'চোখ শুধু বারে বারে পানিতে ভরে উঠছিল। মাথায় বাংলা মায়ের অশ্রুভেজা আর্শীবাদ নিয়ে বাংলাদেশের সবুজ সূর্য আঁকা পতাকা ছুঁয়ে শহীদ এয়ার আহমেদের মত লাখো লাখো বীর শহীদদের আমরা অবনতচিত্তে স্মরণ করলাম। কিন্তু আমাদের আরো অনেক কাজ বাকী; অভিভূত হয়ে বসে থাকার কথা নয়।

 আর দেরী করলাম না। সবাই আমরা মার্চ করে নোয়াখালীর দিকে রওনা দিলাম। নোয়াখালীর সদর মুক্ত করতে যেয়ে আমরা সেদিন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলাম প্রচুর। কিন্তু তা যদি পাক সৈন্যদের দ্বারা হতো তবে বোধহয় সান্ত্বনা পেতাম। তারা ছিল বর্বর আর ঘৃণ্য রাজাকার আর আলবদরের দল। ওরা নানাভাবে আমাদের বাধা দিয়েছে, কিন্তু আমাদের অগ্রগতি তারা রুদ্ধ করতে পারেনি। আমরা তাদের সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ওদের সমূলে ধ্বংস করে নোয়াখালীর সদর মুক্ত করলাম।

 আমরা ক্ষমা করিনি সেই ঘৃণ্য আলবদর আল রাজাতারদের। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দেশের সাথে, নিজের মায়ের সাথে। অস্বীকার করেছে নিজের রক্তকে। তাই ওদের হত্যা করতে কারো এতটুকু বুক কাঁপেনি। কারণ ওরা ক্ষমার যোগ্য নয়। নিজের মায়ের বুকফাটা কান্নায় হৃদয় টলেনি যাদের, নিজের বোনের নির্যাতনের মানবতার সামান্য উদাহরণ দেখাতে পারেনি যারা, নিজের ভাইকে হত্যা করতে হাত কাপেনি এতটুকু ওদের। ওদের ক্ষমা করা যায় না। দেশের সাথে, নিজের অস্তিত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবুও বিবেকের দংশনে জ্বলেপুড়ে মরেনি ওরা। ওরা কি মানুষ? পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।

 ৯ই ডিসেম্বর আমরা নোয়াখালী মুক্ত করলাম। নোয়াখালীর মুক্ত নীল আকাশে সূর্য আঁকা পতাকায় আমরা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষদের সালাম জানালাম। সে সময়কার আনন্দ আর অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সফলতার আনন্দে আর দেশ মুক্তির আনন্দে সবাই শুধু কেঁদেছিল। দলে দলে জনতা মালা হাতে ভিড় জমালো শুধু একনজর আমাদের দেখার আশায়। সেদিন আমরা সবাই শুধু বাঙ্গালী এই পরিচয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।

 আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই আমার দেশবাসী। এরা কত ভালবাসে আমাদের। তাইতো ওদের জন্য আমাদের জন্য দেশমুক্ত করার জন্য সংগ্রামে নেমেছি আমরা। এরা আমার ভাই আমার বাবা আমার মা-বোন, এদের আনন্দে আমরাও মিশে গেলাম তাই একান্ত হয়ে। সেদিন শুধু আমি এই জেনেছি আমার একটি পরিচয়। আমি বাঙ্গালী, এই বাংলাদেশ আমার, এরা সবাই আমার আপন। একই স্নেহ ভালবাসা একই সংস্কৃতি কৃষ্টি ও সভ্যতার বাঁধনে আমরা বন্দী। কাউকে কেউ অস্বীকার করতে পারি না। ওদের মত আমিও দেশের মাটিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। ভালবাসি দেশের এই দুর্ভাগা মানুষগুলোকে।

 ৬ই ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত হলো, তারপর নোয়াখালীর সদর এলাকা। শত্রুমুক্ত করলাম ৯ই ডিসেম্বর, কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ হলো না। ইতিমধ্যে আদেশ এলো চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য। চট্টগ্রাম শত্রুমুক্ত করতেই হবে। আমার কাছে যখন এ আদেশ এলো তখন আমি ফেনীতে। চিটাগাং ফেনী থেকে প্রায় ৬৫ মাইল দূরে। তখন চিটাগাং এবং তার পার্শ্ববর্তী প্রায় সমস্ত এলাকাই শত্রুদের কবলে ছিল। এসব স্থানে তারা বেশ মজবুত ঘাঁটি করে বসেছিল। সংখ্যায় শক্তিতে তারা বেশ শক্তিশালী হয়েই আছে।

 সেদিনই চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা দেবার সমস্ত কাজ শুরু করলাম। দেরী করার আর সময় ছিল না। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আমরা সেদিন দুপুর নাগাদ রওনা দিলাম চট্টগ্রাম অভিমুখে। পিচঢালা