পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

o 3 প্রশ্নঃ 196 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খন্ড গ্রামে। গ্রামবাসীরা আমাদের দেখে শোকে ভরাক্রান্ত না হয়ে তারা আমাদেরকে আরও উৎসাহিত করতে থাকে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। সেই রাতে একজন বৃদ্ধা তিনি তার গরুর দুধ দুইয়ে আমাদেরকে দিলেন। অথচ তাঁরই নাতিকে সকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। তিনি বলছিলেন যে, আমার নাতি গেছে তো কি হয়েছে। দেশ যদি একদিন স্বাধীন হয় তবে আমি সবাইকে ফিরে পাব। তোমাদের মাঝেই আমার নাতিকে পাব। গ্রামবাসীদের এই মনোবল আমাদেরকে শত্রহননে আরও উৎসাহিত করে। আমরা এমনও শুনেছি যে, মুক্তিবাহিনী গ্রাম থেকে আক্রমণ চালালে পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানী সৈন্য সেই গ্রামে হামলা চালাতো, সেই কারণে গ্রামবাসীরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো। কিন্তু পরে যখন মুক্তিবাহিনীর বিজয় হওয়া শুরু হলো তখন গ্রামবাসীরা দ্বিগুণ উৎসাহে সাড়া দিতে লাগলো। আপনাদের এই বিজয়গুলি গ্রামবাসীদের মনে কি রকম সাড়া জাগিয়েছিল? এই প্রশ্নে আমি শুধু বলবো, বেলুনিয়ার পর থেকে ফেনী এবং পরবর্তী পর্যায়ে চট্টগ্রাম-এর দিকে হয়নি, গ্রামবাসীরা কোদাল নিয়ে এসে আমাদের সহযোগিতা করতো, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গোলার আঘাতে গ্রামবাসীরাও হতাহত হতো কিন্তু তবু তারা এগিয়ে আসতো। তাদের মনোবল ছিল অটুট। গ্রামবাসীর মনোবল কত অটুট ছিল সে সম্পর্কে আমি এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করবো। ডিসেম্বর-এর প্রথম সপ্তাহে ইন্ডিয়ান একটা পেট্রোল পার্টি পাকিস্তানী পজিশন-এর পিছনে চলে যায়। পাকিস্তানীরা দেখতে পেয়ে তাদের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে। এক সময় ইন্ডিয়ান পেট্রোল পার্টির গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছিল, সে সময় তারা খবর পাঠায় গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য। আমাদের গ্রামের লোকজন সেই গোলাবারুদ বহন করে নিয়ে যায় প্রায় সাত মাইল পথ অতিক্রম করে। পরে ভারতীয় পেট্রোল-এ যে অফিসার ছিল তার সঙ্গে পরে আমার দেখা হয়। তিনি তখন বলেছিলেন যে, যে দেশের লোকজনের মনোবল এত শক্ত তারা স্বাধীন না হয়ে পারে না। তিনি আরও বলেন যে, ভারতীয় বাহিনীর যে নিয়মিত সাপ্লাই কোর আছে তারাও বোধ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে এত গ্রামবাসীরা। এই যুদ্ধের আর কোন উল্লেখযোগ্য দিক আছে কি? উল্লেখ করার আছে। এই যুদ্ধের পরে যখন আমরা পাকিস্তানী ট্রেঞ্চ এবং বাঙ্কারে তল্লাশী চালাই তখন আমরা একটি ধর্ষিত মহিলার লাশ পাই। বাঙ্কারের পাশে মহিলার সঙ্গে একটি মৃত বাচ্চা ছিল। পাকিস্তানীরা যে কি চরম বর্বরতা দেখিয়ে গেছে সেগুলি আজ আমরা ভুলে গেছি, যার জন্য আজকাল আমরা মুক্তিযুদ্ধকে মনে করি একটি দুর্ঘটনা। এছাড়া পাকিস্তানী বর্বরতার আর কোন ঘটনা মনে পড়ে কি? আমি ঢাকায় দেখেছি ২৫শে মার্চের পরে বাঙ্গালীর মৃতদেহ কিভাবে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে ছিল। এবং আমাদের এনকাউন্টার-এ আমরাও পাকিস্তানী লাশ এভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে যেতাম-এটা আমাদের একটা প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ছিল। এই সংঘর্ষের পরে পাকিস্তানীরা পুরো বেলুনিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ফেনীতে গেয়ে পজিশন নেয়। ফেনীতে আমরা সামনাসামনি ডিফেন্সে প্রায় দুসপ্তাহের কিছু বেশী থাকি। এখানে প্রায়ই পেট্রোলিং হতো, গোলাগুলি হতো, মাঝে মাঝে ওরা আমাদের ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করতো এবং পাকিস্তানীদের প্রতিটি আক্রমণই এখানে প্রতিহত করা হয়েছিল এবং ফেনী পুরোপুরি ফল করে