বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
201

ছিল না এবং আখাউড়া-সিলেট ট্রেন লাইন চালু করতে পারছিল না। বলা বাহুল্য, পাকবাহিনী ২৫শে মার্চের পর এই লাইনে আর কখনো গাড়ি চালাতে পারেনি।

 আমাদের এই ঘাঁটির উপর পাকবাহিনী বার বার আক্রমণ করে এবং এসব আক্রমণে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিদিনই তাদের ২০ থেকে ৩০ জন সৈনিক হারাতে হোত। অবশেষে জুন মাসের ২১ তারিখে পাকবাহিনী আমাদের এই অবস্থানের উপর মারাত্মকভাবে হামলা চালায়। আমার সৈনিক সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোম্পানী। কিন্তু পাকবাহিনী উপর্যুপরি প্রায় চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ চালায়। এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ইটাখোলা, তেলিয়াপাড়ার দক্ষিণ দিকে মনতলার দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটালিয়ন মাধবপুর থেকে মনতলার দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটালিয়ন চানহরা থেকে হরশপুরের দিকে অগ্রসর হয়। আর এক ব্যাটালিয়ন [মুকুন্দপুর থেকে হরশপুর-এর দিকে অগ্রসর হয়।

 একই সময়ে চারিদিক থেকে তারা আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে এবং এ আক্রমণে তারা দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র বেপরোয়াভাবে, ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। যখন তিন দিক থেকে তারা আমাদের উপর আক্রমণ করতে অগ্রসর হচ্ছিল তখন হেলিকপ্টারযোগে তারা পিছনে কিছু সংখ্যক কমাণ্ডো অবতরণ করায়। আমি শেষ পর্যন্ত আমার সৈনিকদের পিছনে হটে যেতে আদেশ দেই। হরশপুরের নিকট আমার যে কোম্পানী ছিল তারা পাকসৈন্যদের প্রায় ঘেরাওয়ের ভিতরে পড়ে যায়। এই কোম্পানীকে ঘেরাও থেকে উদ্ধার করতে আমার বেগ পেতে হয়েছিল। যদিও আমরা আমাদের অবস্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তবুও শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বর্গমাইল এলাকা আমাদের আওত্তাধীন রাখতে সমর্থ হয়েছিলাম। এই এলাকা স্বাধীনতা লাভের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মুক্ত ছিল।

 ঐদিনই ২১শে জুন আমি আমার লোকজনকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতের ভিতর চলে যেতে বাধ্য হই। ভারতে চলে যাবার পর আমরা পূর্ণোদ্যমে নবাগত তরুণদের ট্রেনিং দিতে শুরু করি, যাতে করে গণবাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও গড়ে ওঠে। ভারতে চলে যাবার আগে থেকেই আমরা গণবাহিনী গড়ে তোলার জন্য ট্রেনিং দেয়া শুরু করি। এবং ভারতে যাবার পর ট্রেনিং আরও জোরদার করি। জুন মাস পর্যন্ত আমরা বেশ কিছু সংখ্যক যুবকদের ট্রেনিং দিয়েছিলাম।

 যে সমস্ত টাস্ক দিয়ে গেরিলাদের ভিতরে পাঠাতাম, সে সমস্ত টাস্ক যাতে সুসংহত ও সুপরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয়, সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য জুলাই মাসের ৭/৮ তারিখে সমস্ত সেক্টর কমাণ্ডারদের মুজিব নগরে এক কনফারেন্স হয়। এই কনফারেন্স-এ প্রথম সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি আমাদের লক্ষ্য করে যে ভাষণ দেন তার মর্ম ছিল যে- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের উপর যে অত্যাচার অবিচার করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমরা এখানে। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছি, তা স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত যেন চালিয়ে যেতে পারি। এতে আমাদের সবাইকে একই লক্ষ্য সামনে রেখে কার্য পরিচালনা করা উচিত। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিভিন্ন মহলের প্ররোচনায় আমরা যেন পথভ্রষ্ট না হই। বাংলাদেশ সরকার যথাসাধ্য সর্বপ্রকার সাহায্য করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অস্ত্রশস্ত্র সমরসম্ভার বন্ধুরাষ্ট্র ভারত যতটুকু দেয় তা আমরা গ্রহণ করব। তাছাড়াও যদি সম্ভব হয় অন্য কোন রাষ্ট্র থেকেও আনার চেষ্টা করব। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আমরা অনুপ্রাণিত হই।

 কিভাবে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে এ ব্যাপারে পরে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। কনফারেন্স প্রায় দশদিন পর্যন্ত চলে। এই কনফারেন্স বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা পদ্ধতিতে কিভাবে লড়াই চালাতে হবে সে পরিকল্পনা নেয়া হয়, যাতে করে সমস্ত সেক্টর একই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারে। যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ গুলো হলো-

 ১। সেক্টরের সীমানা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়।