বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
206

 ২৫শে মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী পিলখানাস্থ ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে প্রায় ৭০০ থেকে এক হাজার ইপিআর-এর বাঙ্গালী সৈন্যকে জেলখানাতে আটকে রাখে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত তাদের উপর নানারকম নির্যাতন চালায় এবং তাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নেয় যে তারা কখনো পাক সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে না এবং তাদের সুযোগ দেয়া হবে আনুগত্য প্রমাণ করার জন্য। এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে কিছুসংখ্যক ইপিআর সৈনিকদের পাকিস্তানী সেনাদের নেতৃত্বাধীনে তাদের থানায় থানায় মোতায়েন করা হয়। আমাদের এলাকায় যে সমস্ত জায়গায় তাদের মোতায়েন করা হয়েছিল সেসব জায়গা হল রায়পুরা, নরসিংদী, শিবপুর, মনোহরদী, কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ ইত্যাদি। এসব জায়গাতে ইপিআর এবং পাক বাহিনীর লোকদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান ছিল। আমরা যেসব গেরিলা বেইস তৈরী করেছিলাম তারা প্রায় সবাই ইপিআর-এর বাঙালী সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ করে ই-পি-আর এর সৈনিকদের আমাদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে বললে তারা বলে যে তারা সংখ্যায় খুব কম। বেশীরভাগ এখনো জেলে আছে। তারা যদি পাকবাহিনীর কাছে আনুগত্য প্রমাণ করতে পারে তাহলে বাকী সৈনিকদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে। এখন যদি তারা গেরিলাদের সাথে যোগ দেয়, তাহলে যে সমস্ত ইপিআর-এর লোক জেলে আছে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এমতাবস্থায় পাক সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছেড়ে আসার সময় এখনো হয়নি। তবে সময় আসলে তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে থাকবে বলে নিশ্চয়তা দেয়।

 মনোহরদীতেও ছিল অনুরূপ এক ক্যাম্প। সেখানে পাকসেনাদের সংখ্যা ছিল ৩৬ জন এবং প্রাক্তন ই-পিআর-এর লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জন। ২১শে অক্টোবরের আগে থেকেই আমাদের গেরিলা বেইস যেটা মনোহরদীতে ছিল তাদের সাথে যোগসূত্র কায়েম হয় এবং এই প্রতিশ্রুতি নেয়া হয় যে যখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ করবে তখন তারা আমাদের সাথে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়বে। ২১শে অক্টোবর হাবিলদার আকমল প্রায় এক কোম্পানী গেরিলা নিয়ে মনোহরদীতে পাকিস্তানী বেইস অবরোধ করে। এই অবরোধের সময় ইপিআর-এর যেসব লোক পাকিস্তানীদের সাথে ছিল তারা হাবিলদার আকমলের পক্ষে চলে আসে এবং যুদ্ধ শুরু হয়।

 এ যুদ্ধ প্রায় কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। অবশেষে পাকবাহিনীর প্রায় ২৫ জনের মত সৈনিক মারা যায়। বাকী ১১ জন আমাদের সৈনিকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমপর্ণকারী পাকিস্তানী সৈনিদের বেঁধে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবার সময় পথিমধ্যে ক্রুদ্ধ জনতা অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং মাত্র ৪ জনকে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এ যুদ্ধে হাবিলাদার আকমলের কার্যাবলী অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ যুদ্ধে এটাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, বাঙালীরা যে যেখানেই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো।

 এ সমস্ত উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছাড়া আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন আমার সৈনিকরা সাফল্যজনকভাবে সমাধা করেছে। তার সংখ্যা এত বেশী যেসব অপারেশনের বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জুলাই মাসের ৭/৮ তারিখে মুজিব নগরে সেক্টর কমাণ্ডারদের যে কনফারেন্স হয়েছিল সে কনফারেন্স-এ তদানীন্তন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর প্রধান যেসব নির্দেশাবলী আমাদের দিয়েছিলেন সেগুলো আমরা যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হই। তা নিদর্শন নিম্নে দেয়া হলঃ

 গেরিলা তৎপরতা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি তৈরী করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিয়ন্ত্রাণাধীন এলাকার মধ্যে যে গেরিলা ঘাঁটি ছিল, সেগুলো হলোঃ ১। সিলেটের চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ এবং বানিয়াচংগ, ২। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাতে নাসিরবগর, সরাইল, মুকুন্দপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৩। কুমিল্লাতে নবীনগর থানা, ৪। ঢাকা জেলায় রায়পুরা, শিবপুর, নরসিংদী, কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর, মনোহরদী, জয়দেবপুর এবং কালীগঞ্জ, ৫। ময়মনসিংহে গফরগাঁও এবং ভালুকা, ৬। কিশোরগঞ্জ মহকুমাতে কিশোরগঞ্জ, কুলিয়ার চর, বাজিতপুর, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া এবং হোসেনপুর।