পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
215

এবং জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞাসা করি, “স্যার ডু ইউ রিমেম্বার মি? আই এ্যাম এক্স-মেজর শফিউল্লাহ অব টু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এ্যাণ্ড নাউ কর্নেল শফিউল্লাহ অব বাংলাদেশ আর্মি।”

 জেনারেল নিয়াজীকে খুবই চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি আমার কোন কথার জবাব না দিয়ে শুধু মাখা নেড়ে সায় দিলেন যে তিনি আমাকে চিনেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারযোগে জেনারেল আরোরা তাঁর দলবলসহ বিমান বন্দরে পৌঁছেন। এরপর বিমানবন্দর থেকে আমরা তদানীন্তন রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছি। সেখানে সেদিন বহু লোকের সমাগম হয়েছিল। জেনারেল আরোরার সাথে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে এয়ার কমোডোর) খোন্দকারও এসেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার জন্য।

 বেলা প্রায় পাঁচটার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেনারেল নিয়াজী যৌথ কমাণ্ডের (বাংলাদেশ ভরত) নিকট আত্মসমর্পণ দলিল স্বক্ষর করেন। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে এয়ার কমোডোর) খোন্দকার এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ ময়মনসিংহ বসে ঢাকা দখলের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল।

 ঢাকা দখলের যে গৌরব তা আমার ফোর্সের প্রথম ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে পাঁচটায় আমার ফোর্স ঢাকা স্টেডিয়ামে শিবির স্থাপন করে। ১৬ই ডিসেম্বর আমার হেডকোয়ার্টার ঢাকাতে পৌঁছে যায়। প্রথম সেটা স্থাপিত হয় স্টেডিয়ামের পাবনা এম্পোরিয়ামের তেতলার এবং ১৭ই ডিসেম্বর সেটা আমি ৩৫, মিণ্টু রোড-এ স্থানান্তর করি। ঢাকা সেনানিবাসে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করার পূর্ব পর্যন্ত আমার হেডকোয়ার্টার ৩৫, মিণ্টু রোডে থেকে যায়। ২য় ইস্ট বেঙ্গল তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থান করে। ভৈরবে আত্মসমর্পণের পর ১১ইস্ট বেঙ্গল ভৈরব থেকে ঢাকা চলে আসে এবং ভিকারুন্নিসা বালিকা বিদ্যালয়ে তারা প্রথম কয়েকদিন আবস্থান করে। সেক্টর ট্রুপসদের জায়গা দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ, আজিমপুর ইত্যাদি স্থানে। এই সেক্টর ট্রুপস পরে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নামে পরিচিত।

 এ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার সেক্টর যে সব যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যকলাপ হতো সেগুলো আমি কখনো পাবলিসিটি করতে দেইনি। করণ ৩০শে মার্চ ১৯৭১-এ আমি যখন ভৈরব ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছি তখন কিছু সংখ্যক বিদেশী এবং ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমার দেখা হয়। তারা আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছিল এবং সে প্রশ্নের জবাব তার কিছুদিন পর ভারতীয় সাংবাদপত্রে দেখতে পাই। যেমন আমার ব্যাটালিয়ন কোন দিক থেকে, কোথা থেকে এসেছে? সৈন্য সংখ্যা কত ও কতজন অফিসার এবং কি করতে যাচ্ছি? এ সমস্ত গোপন তথ্য আমি পত্রিকাতে দেখতে পেয়ে সাংবাদিকদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলি। এবং পরবর্তীতে নয় মাসের যুদ্ধে কোন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেইনি। এতে যদিও গোপন তথ্য গোপন রাখতে পেরেছি কিন্তু আমার মনে হয় আমার সেক্টরের ছেলেরা যেভাবে কাজ করেছে তা বাংলাদেশের কেউ জানে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস সত্য কখনো গোপন থাকে না। আমার ছেলেরা যে উত্তম কাজ করেছে তা যারা স্বচক্ষে দেখেছে, তারাই লোকদের যতোটুকু বলেছে, সেটাই আমি অনেক বেশি মনে করি। এ সেক্টরের কার্যকলাপ আমি লোকমুখে যতোটুকু শুনতে পাই তা এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়।

 ভারতে থাকাকালীন ভারতীয় হাসপাতালের সাহায্য ছাড়াও আমি দুখানা হাসপাতাল তৈরী করেছিলাম। এর একটা ছিল আমার হেড কোয়ার্টার হেজামারাতে; সেটা ছিল ৩০ বেডের। অপরটি ছিল আশ্রম বাড়ীতে। সেটা ছিল ১০ বেডের। আমাদের সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর চিকিৎসা ছাড়াও নিকটবর্তী গ্রামবাসীরাও এ হাসপাতালে চিকিৎসা লাভ করতো। এ নয় মাসের সংগ্রামে আমাদের প্রতিবেশী ভারত সরকার আমাদের যে ভাবে সাহায্য করেছিল তা হয়তো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তারা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। সমস্ত সীমান্ত এলাকাতে লাখ লাখ শরণার্থীদের থাকার, খাবার পরার ব্যবস্থা যে সুশৃঙ্খলভাবে করা হয়েছিল