১০নভেম্বর বেলুনিয়া বালুজ-এ অবস্থানরত পাকসেনাদের ছত্রভঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে আমি শত্রুপক্ষের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে দুই ভাগ করে দেই যে তাদের যোগাযোগ বা একত্রিত হওয়া সম্ভব না হয়। আমার কোম্পানীসহ দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৪ কোম্পানী এখানে চারদিন অবস্থান করি এবং যুদ্ধ করি। তারা ১ জন নায়েক শহীদ হন এবং ১জন নায়েক সুবেদার আহত হয়। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে এবং তৃতীয় দিনে আমাদের উপর পাক বিমান বাহিনী আক্রমণ করে। এতে দুজন মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং ১ জন মুক্তিসেনা গুরুতরভাবে আহত হন।
১৫ই নভেম্বর এভাবে অনবরত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১ ব্যাটালিয়ন ইণ্ডিয়ান আর্মি ঢুকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে এবং তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ফলে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৫০জন ইণ্ডিয়ান আর্মির হাতে বন্দী হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হবার পর দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৪ কোম্পানীসহ আমার কোম্পানীকে ফেনী পৌঁছে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিতে আদেশ করা হয়।
প্রথমে আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই এবং পরপর দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৪ কোম্পানীও পৌঁছে। ২৩শে নভেম্বর এ দিন ফেনী এয়ারপোর্টের প্রায় কছাকাছি পৌঁছে আমরা ডিফেন্স বসাই। ফলে এয়ারপোর্ট থেকে পাক বাহিনী সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
২৬শে নভেম্বর আমার কোম্পনী তুলে নিয়ে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের যোগদান করার নির্দেশ পাই। ২৮শে নভেম্বর আমি আমার কোম্পানী তুলে নিয়ে আখাউড়া রওনা হই। এবং ২৯শে নভেম্বর আখাউড়া পৌঁছি। আখাউড়া পৌঁছে দেখতে পাই আমার ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আখাউড়া অপারেশন করার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে।
১লা ডিসেম্বর পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে রাজাপুর এবং আজমপুর গ্রামে অবস্থানকারী পাকসেনাদের উপর চরম আঘাত হানি। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচণ্ড মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানে শত্রু পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ২৫ জন খানসেনা আমাদের হাতে বন্দী হয়। এখানে আমদের লেঃ বদিউজ্জামান ও একজন নায়েক সুবেদারসহ কয়েকজন শহীদ হন। রাজাপুর এবং আজমপুর আমরা দখল করতে সক্ষম হই।
৬ই ডিসেম্বর আমরা ডেমরার অভিমুখে রওনা হই এবং ১২ই ডিসেম্বর ডেমরা পৌঁছি। ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করি।
১৬ই ডিসেম্বর ডেমরা থেকে রওনা হয়ে যখন বালুনদী অতিক্রম করি তখন বিকেল সাড়ে চারটা। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম পশু শক্তি বর্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা। আত্মসমর্পণের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। হাজার হাজার জনতা জয়োল্লাসে ফেটে পড়ে রাস্তায় রাস্তায় “জয় বাংলা” আর “জয় মুজিব” স্লোগান আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলে। আমরা সোজা ঢাকার অভিমুখে রওনা দেই। রাস্তায় একইভাবে জনসাধরণ আমাদের স্বাগত জানাতে থাকে এবং বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। রাত ১২টা সময় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি এবং সেখানে অবস্থান করি।
ঐতিজহাসিক ঢাকা নগরীও তখন লোকে লোকারণ্যে। সারা রাত ধরে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আনন্দে আকাশে অসংখ্য ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যে সমস্ত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপি আর, পুলিশ, মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও জনসাধারণ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন তাদের নাম বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে স্বর্ণক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে, এই কামনাই করি। নয় মাসের যুদ্ধে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাকিস্তান পদাতিক বাহিনীর চরম পরাজয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বাঙ্গালী সৈনিক, যুবক, তথা জনসাধারণ প্রকৃতপক্ষেই সৎ সাহসী, বীর সৈনিক ও রণকৌশল। এ দেশের আপামর জনসাধারণ একযোগে একবাক্যে সম্মিলিত হয়ে