পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
225

ট্যাংক। ভারতীয়রা যখন সেই দালানগুলির মাঝমাঝি চলে এসেছিল তখন আমরা ৪/৫ মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না যে এই গোলাগুলির আওয়াজ কোথা থেকে হচ্ছে। তারপর দেখলাম যে ভারতীয় সৈন্যরা কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, কাউকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে, কারো শরীর দিয়ে রক্ত রেয়ে পড়ছে। ৫/১০ জন করে পিছনের দিকে আমরা যেখানে আছি সেই লাইনের দিকে সরে আসছে। সেখানে চারটা ছোট ট্যাংকের মধ্যে দুটো জ্বলে গিয়েছিল এবং দুটো ট্যাংক নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল ভারতীয়রা। তখন আমাকে ওয়ারলেসে বলা হলো যে তোমার কোম্পানী নিয়ে তুমি তাড়াতাড়ি পিছনে চলে এসো। আমরা যেখানে ছিলাম তার থেকে ২০০গজ পিছনে আরেকটা উঁচু জায়গা ছিল এবং তারপর আধ মাইলের মতো পরিস্কার জায়গা এবং তারপরই গ্রাম শুরু হয়ে গেছে। এই সময় দেখি যে পাকিস্তানী আর্মি সামনের ঐ জায়গা দিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তখন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের রেঞ্জের ভিতরে। তখন আমরা উইড্রো করে সামনের আসলাম। এর মধ্যে দৌড়াদৌড়া শুরু হয়ে গেছে। পিছনে ভারতীয় আর্মির যারা বেঁচে ছিল বা যারা চলতে পারে তারা সামনে চলে এসেছে। তখন এসে আমি জেনারেল শফিউল্লাহকে পেলাম। তিনি একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ভারতীয় আর্মি এতো বড় একটা ভুল করে ফেললো যা কল্পনা করা যায় না। আমরা দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যরাও আছে। এর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে এবং আশপাশ অনেক লোক পড়েও গেছে। তখন আমি শফিউল্লাহকে বললাম যে স্যার দৌড় দেন। আমি আর শফিউল্লাহ দৌড়ে ঐ দূরুত্বটা পার হই এবং যখন দেখলাম যে গোলাগুলি খুব বেশী শুরু হয়ে গেছে তখন আমরা শুয়ে পড়লাম। ২/১ মিনিট শুয়ে থাকার পর আবার উঠে দৌড়ে যেখানে থেকে গ্রাম শুরু হয়েছে সেখানে একটা পুল ছিল সেটা পার হয়ে গ্রামের সীমানার মধ্যে ঢুকে গেলাম। পরে আমরা শুনলাম আমরা প্রথমে যে জায়গায় ছিলাম পাকিস্তান আর্মিরা সেই পর্যন্ত এসছিল আর এগিয়ে যায়নি। তার পরদিন সকাল বেলা অর্ডার এলো তোমরা যাও। কারণ আশুগঞ্জে থেকে পাকিস্তানী আর্মিরা চলে গেছে। তারপর আমরা আশুগঞ্জ গেলাম। গিয়ে দেখি ওরা চলে গেছে এবং জিনিসপত্র সব বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানী আর্মিরা সন্ধ্যার পরপরই নদী পার হয়ে ওপারে চলে গিয়েছিল। যে সব ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল তাদের লাশ পাকিস্তানীরা আগেই সরিয়ে ফেলেছিল। তবে সেখানে গিয়ে আমি মেজর মুখার্জীর লাশটা দেখেছিলাম। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এর মধ্যে ভৈরবের দিক থেকে শেলিং শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও কিছু আর্টলারী চলে এসেছে। ইতিমধ্যে মুজিব ব্যাটারীও এসেছে, তারাও অপারেশন করছে। ভারতীয় বাহিনীও এসে গেছে। লেঃ কর্ণেল আজিজও তখন এখানে আমাদের সাথে ছিলেন, আরও অনেক অফিসার ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তানী আর্মি সারেণ্ডার করে সেদিন সরাদিন প্রচুর ফাঁকা গুলি ও ফুর্তি হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির যারা ভৈরবে, ছিল তারা ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সারেণ্ডার করেনি। ১৯শে কি ২০ শে ডিসেম্বর ভারতীয় জেনারেল গেলেন ভৈরব, তারপর তারা সারেপ্তার করে। তারপর দুই দিন সময় লাগে পাকিস্তানীদের সরিয়ে জায়গা খালি করতে।

মেজর এস, এ ভূঁইয়া প্রতিবেদন[১]

॥ একটি এ্যামবুশ ও সুবেদার চান মিয়ার বীরত্ব ॥

 প্রায় সাড় তিন মাসের মত আমি বি-কোম্পানীর সাথে মনতলায় ছিলাম। ঐ সময়ের মধ্যে আমরা অনেক ছোট বড় অপারেশন করছি। সবগুলোর বিবরণ লেখা সম্ভব নয় বলে আমি মাত্র কয়েকটির কথা নীচে লিখলাম।

 ২৭শে জুন রাত্রে আমি বি-কোম্পানীকে নিয়ে বাংলাদেশের ভিতর যাই। দিনের বেলায় গিয়ে শত্রু সৈন্যরা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, কেমন ভাবে অবস্থান করছে তাই দেখবার জন্য ভিতরে যাই। দেখতে পাই সিপাই থানার সামনে শত্রুর দুটো ছোট ঘাঁটি আছে এবং তারা সেখানে বিনা দ্বিধায় চলাফেরা করছে। তাদের সংখ্যা


  1. ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। প্রতিবেদনগুলি তাঁর রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।