পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
227

 পাকিস্তানী রেডিও সেদিন প্রচার করা হয়েছিল যে, আমাদের মৃত্যের সংখ্যা ২০ জন। কিন্তু প্রকৃত খবর পাই ঘটনার ৫দিন পরে। শত্রুপক্ষে নিহত হয় ১৭ জন আর আহত হয় ১৯ জন। গোপন অবস্থান থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করলে দিশেহারা শত্রু সৈন্যদের আত্মরক্ষার প্রায় উপায় থাকে না এবং তখন তাদের এমনি সীমাহীন ক্ষতি মেনে নিতে হয়। এর সাধারণ কারণ এক পক্ষের সতর্কতামূলক পূর্বপ্রস্তুতি, অন্য পক্ষের অজানা বিপদ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং অপ্রস্তুতি। আর শত্রুপক্ষ সমরশক্তিতে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেন আকস্মিকভাবে এমনি ওঁৎ পাতা ফাঁদে পড়লে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় এবং সাধারণ মনোবল হারিয়ে ফেলে। সে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় সেই মুহূর্তে অংশ নিতে আর সাহস পায় না। ফলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোটাই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে।

 যাহোক, অপূর্ব সাহস দেখিয়েছিলেন সেদিন সুবেদার চান মিয়া। ঐ দিনের যুদ্ধের পর চান মিয়ার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছিল। পরে কর্তৃপক্ষ কোন এক কারণে আমার দল থেকে তাকে বদলী করতে চাইলেও আমি তাতে রাজি হইনি।

॥ আর একটি রেইড ॥

 আর একটি ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করছি। দিনটি ছিল ৮ই জুলাই। ২৭শে জুন যে স্থানটিতে আমরা এ্যামবুশ করেছিলাম, পাক সৈন্যরা সেখানে নতুন করে কতকগুলো বাঙ্কার করেছিল। নতুন করে তারা আরও অনেক সৈন্য এনে তাদের অবস্থানকে মজুবত করে তুলেছিল। আমরা প্ল্যান করলাম রেইড করে শত্রুর নবনির্মিত বাঙ্কারগুলি উড়িয়ে দেবো। ২৭ শে জুন তারিখে আমাদের হাতে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা সীমান্ত এলাকার দিকে আর আসতো না অথবা অবস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও নড়াচড়া করা তারা অর্থহীন বলে মনে করতে। ২৭শে জুন এবং ৮ জুলাই তারিখে মধ্যে আমরা বার কয়েক শত্রুঘাঁটির কাছে ওঁৎ পেতে ছিলাম কিন্তু পাকসেনারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে না বেরুনোর জন্য আমরা বিশেষ সুবিধা করতে পারিনী। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থানের উপর আমরা কয়েকবার ৩ইঞ্চি মর্টার দিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিলাম।

 ৮ই জুলাই তারিখে আমরা সমস্ত কোম্পানী নিয়ে দুই দিক থেকে শত্রুর এলাকায় ঢুকলাম। ভোর চারটার দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। শত্রুর অবস্থান ভারত সীমান্ত থেকে বেশি দূর ছিল না। সিদাই থানা থেকে তাদের অবস্থানগুলো আমাদের নজরে পড়তো। আমরা শত্রুকে মাঝখানে রেখে দুই পাশ থেকে ঢুকলাম। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা রিকয়েললেস রাইফেল ও মর্টার শত্রুর দিকে তাক করে রেখেছিলাম। আগে থেকেই সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম যাতে একই সময়ে রিকয়েললেস রাইফেল, মর্টার রাইফেল সব কিছুর সাহায্যে আমাদের সৈন্যরা একযোগে শত্রুদের উপর আঘাত হানতে পারে। ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় শত্রুর অবস্থানের উপর আমরা আতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলাম। রিকয়েললেস রাইফেলের গোলার আঘাতে শত্রুদের দুটো বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়া হলো। সবচেয়ে ভালো কাজ করলো মর্টারগুলো। আমরা পনেরো মিনিট গোলাগুলি বর্ষণ করার পর পাক সেনারা আমাদের উপর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে দিল। ঐ এলাকার শত্রুর প্রতি সম্ভাব্য আক্রমণের স্থানগুলো তাদের কামানের লক্ষ্য কেন্দ্র হিসেবে পূর্বনির্দিষ্ট ছিল। জ্যামিতিক নিয়মমাফিক তাদের কয়েকটা গোলা আমাদের অবস্থানের উপর এসে পড়ে। বিপদ বুঝে ঐখান থেকে আমরা আমাদের বাহিনী সরিয়ে নিয়ে আসি। ঐ আক্রমণে পাকবাহিনীর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় এক সপ্তাহ পরে বেসামরিক লোক মরফত আমরা সে খরব পাই। পাক সেনাদের ৬ জন সৈন্য মৃত্যের তালিকা পূর্ণ করেছিল।

॥ ধর্মঘরে সুবেদার তৈয়বের কৃতিত্ব ॥

 আমার সাবসেক্টরের মধ্যে ধর্মঘরে এসে অধিক পরিমাণ পাকিস্তানী সৈন্য জমায়েত হয়। ধর্মঘর ছিল সাবেক ইস্ট পাকিস্তানী রাইফেল বাহিনীর বিওপি অর্থাৎ বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে আসার পর থেকে আমি সেখানে কোন দিন অপারেশন করিনি। তারপর ঐ শত্রুঘাঁটির উপর মনোযোগ দিলাম। আমি