নিজে প্রায় ৫০জন সৈন্য নিয়ে দু' দু' বার ঐ এলাকায় গোপনে আতর্কিত আক্রমণ করার জন্য ফাঁদ পেতেছিলাম, কিন্তু শত্রুরা একবারও তার কাছে ভেড়েনি। তাই দূর থেকে কিছু করা যায় কিনা তারই ফন্দীফিকির আঁটলাম।
ঐ এলাকায় কয়েকবার মর্টারের সাহায্য আমরা গোলাবর্ষণ করি। আমাদের সঙ্গে ছিল সুবেদার তৈয়ব। মর্টারের গোলাবর্ষণে সুবেদার তৈয়ব একজন দক্ষ ওস্তাদ। যতবারই তিনি শত্রু ঘাঁটিতে মর্টারের সাহায্য গোলাবর্ষণ করেছেন ততবারই শত্রুর কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে। একবার আমাদের কয়েকটি মর্টারের গোলা ধর্মঘর দীঘিতে পড়ায় দীঘির বহু মাছ মরে গিয়েছিল। সারা ধর্মঘরের লোক কয়েকদিন ধরে সেই মাছ খেয়েছিলেন।
অন্য আর একদিন আমরা দুই দিক থেকে ৪টি মর্টার দিয়ে শত্রু সৈন্যের ধর্মঘর পজিশনের উপর গোলাবর্ষণ করি। সেদিন মেজর মতিনের কোম্পানী থেকে ২টি মর্টার ধার করে এনেছিলাম। আমরা প্রায় ৬০টি মর্টারের গোলা ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের গোলাবর্ষণ ছিল অত্যন্ত নির্ভুল। কয়েকদিন পরে আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের গোলা সঠিক জায়গায় পড়ায় পাঞ্জাবীরা ঐ জায়গা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
মতিন সাহেবের কোম্পানীতে নায়েক আজিজ নামে একজন যুবক ছিল। মর্টারের গোলাবর্ষণে যে বেশ সাফল্য অর্জন করেছিল। তার মর্টার ফায়ার সম্বন্ধে কোম্পানীতে বেশ সুনাম ছিল।
এই এলাকাতেও রাজাকারের সংখ্যা ছিল খুব বেশী। ঐ রাজাকারদের চোখে ধুলো দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তারা কেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করতো না তা বুঝতে পারিনী। সম্ভবত ঐ এলাকার মত রাজাকার বাংলাদেশের কোথাও ছিল না। তারা পাঞ্জাবী সৈন্যদের পথ দেখিয়ে ভারতের সীমানার কাছে এসে আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাঞ্জবীদের সহযোগিতা করতে শুরু করলো। তাদের এই ক্রিয়াকলাপে আমরা গভীর ভাবে ব্যথিত হতাম।
যাহোক, বিজয়নগর এলাকাতেও আমরা কয়েকটি গোপন আতর্কিত হামলা চালাই। কিন্তু তাতেও আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারিনী। মাত্র একদিন এ্যামবুশ করে কয়েকজন পাঞ্জাবীকে যমদ্বারে পাঠিয়ে দিই।
॥ বীর মুজাহিদ দুলা॥
এ প্রসঙ্গে কয়েকজন মুজহিদের নাম করা যায় যাদের আমি তেলিয়াপাড়াতে দেখেছি। এদের মধ্যে মনে রাখার মতো দুটি নাম দুলা এবং আহাদ। দুলার বয়স ছিল ২৬ বছর। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার শালদা নদীর কছে। সে মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের কোম্পানীতে মেজর মতিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সমগ্র মুক্তিবাহিনীতে দুলার মতো সাহসী যুবক আর কজন ছিল আমার জানা নেই। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে সে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার তুলনা হয় না। বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণের মধ্যেও এই অকুতোভয় যুবক লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেনি কিংবা রণক্ষেত্র ছেড়ে দূরে সরে যায়নি, আপন লোকদেরকেও সে গোলাবারুদ বিতরণ করেছিল।
২১শে জুন আমি যখন শত্রুর ত্রিমুখী প্রচণ্ড আক্রমণের দারুন মনতলা থেকে সরে আসতে বাধ্য হই সেদিন দুলা কলকলিয়ার লড়াইয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তার কিছুটা পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।
কলকলিয়া ছিল ক্যাপ্টেন মোর্শেদের অধীনে এবং দুলা সেই ফ্রণ্টেই লড়ছিল। ২১শে জুন রাতে শত্রু বাহিনী যখন আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় সেই একই সময়ে কলকলিয়াতেও তারা আক্রমণ চালায়। মোর্শেদের সৈন্যরা শত্রুদের সাথে সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা বহুগুণ বেশী থাকায় মোর্শেদের দল সেখান থেকে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে সময় দুলা মিয়ার হাতে ছিল একটা হালকা মেশিন গান