পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
229

সে তার হালকা মেশিন গান অনবরত গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল এবং শত্রুর অগ্রগতিকে সারারাত ব্যাহত করে রেখেছিল। নিঃশঙ্কচিত্তে অপারবিক্রমে সে এক ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। অবস্থা প্রতিকূল দেখে যখন তার সংগীরা আত্মরক্ষা করতে পিছু হটছিল তখন দুলা সেই পশ্চাদপসরণে অংশগ্রহণ না করে নির্ভয়ে তার হালকা মেশিন গান থেকে অবিরাম গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। তারই অসীম সাহসিকতা ও গুলি ছোড়ার ফলে দলের অন্যান্যরা পিছু হটার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু দুলার বড়ই দুর্ভাগ্য, সে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে এক মহা বিপদে আটকে পড়ে। শত্রুপক্ষের মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি এসে দুলাকে বিদ্ধ করে। দুলার পক্ষে একমাত্র দুলার মেশিনগানই সক্রিয় ছিল এবং শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতাকে তারই মেশিনগানটি কিছুটা বাধা দিচ্ছিল। ফলে শত্রুর একমাত্র লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিল দুলা। অবশেষে শত্রুরা দুলাকে আহত করতে সক্ষম হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু নিদারুণ আহত অবস্থায় দুলা সংজ্ঞা হারায়নি এবং শেষ কর্তব্য স্থির করে সে তার হালকা মেশিনগান থেকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুকে বাধা দিয়ে যাবে বলে স্থির করল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে জান দেবে কিন্তু জীবিত অবস্থায় তার শরীরকে শত্রুহস্তে কলুষিত হতে দেবে না।

 আমি যখন মনতলা থেকে সরে এসে ভারতের সিদাই থানায় (আগরতলার উত্তরে) তখন লে. কর্নেল শফিউল্লাহ আমার এখানে উস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর তিনি আমাকে মোর্শেদের অবস্থানের কথা জানালেন এবং তারাতাড়ি কলকলিয়া চলে যেতে আমাকে নির্দেশ দিলেন। তিনি আরো বললেন, “মোর্শেদের সৈন্যরা দারুণ বিপদে আছে। তারা সবাই শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের বিপদমুক্ত করতে সাহায্য কর।”

 এই কথা বলে তিনি কলকলিয়া চলে গেলেন এবং তাঁর পিছু পিছু আমিও কলকলিয়া পৌঁছুলাম। আমরা যাওয়ার পর দেখতে পেলাম আল্লাহর মেহেরবানীতে ক্যাপ্টেন মোর্শেদসহ তার কোম্পানীর সবাই নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে। তাদের সবাইকে দেখে আমরা আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করলাম।

 সবাই এল কিন্তু তখনো পর্যন্ত দুলা এলো না। তখন বেলা ১১টা খবর এলো দুলার পেটে এবং ডান পায়ে কয়েকটি গুলি লেগেছে। সে কাদা পানির মধ্যে অসহায় পড়ে আছে। ছোট্ট একটা সৈন্যবাহিনী গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে না পেরে ফিরে এসেছে। শত্রু তখন মেশিনগান বসিয়ে পজিশন নিয়ে আছে এবং কাউকে নড়তে দেখলেই গুলি ছুড়ছে। শত্রুমেশিনগান বাসিয়েছিল ছোট্ট একটি টিলার উপর।

 আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাছ থেকে দূরবীন নিয়ে দেখলাম শত্রুর কিছু সৈন্য পজিশন নিয়ে আছে এবং অন্যান্যরা পরিখা খনন করছে। আমরা সবাই চিন্তা করছি দুলাকে কিভাবে শত্রুদের ঐ বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করব। কোন একটা ফন্দি উদ্ভাবনে আমরা যখন চিন্তিত তখনই একটি ছেলে দৌড়ে এসে খবর দিল যে দুলাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। আহত দুলা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সম্পূর্ণ নিস্তেজ এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলে শত্রুরা তাকে মৃত মনে করেছিল এবং তার দিকে আর গুলি ছোঁড়া প্রয়োজন নেই মনে করে তারাও গুলি ছোড়া বন্ধ করেছিল। এই রকম একটা সুযোগ পেয়ে আমাদের দুই সাহসী ছেলে সন্তর্পণে নালার ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে দুলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।

 দুলাকে যখন আমাদের সামনে আনা হলো তখনকার দৃশ্য এত করুণ এবং বেদনাদায়ক যে তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মুহূর্ষ দুলা বাম হাত দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ পেট চেপে ধরে আছে। কেননা ক্ষতস্থান থেকে তার নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম করছিল। ডান পায়ে গুলি লেগে ছিন্নভিন্ন মাংসগুলি কোনক্রমে পায়ের হাড়ের সংগে লেগেছিল। আর তার সমস্ত শরীর রক্তরঞ্জিত।

 একটা গুলিবিদ্ধ বাঘের মত ছটফট করছিল। তখনও সে বাকশক্তি হারায়নি। আমাদের চোখের দিকে চোখ রেখে সে বলল, স্যার, আমি আর বাঁচব না, এক্ষুনি মারা যাব। আমার আফসোস রয়ে গেল স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমি মরতে পারলাম না। স্বাধীন বাংলা দেখা আমার ভাগ্যে হয়ে উঠল না। স্যার আমাকে কথা দিন