পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
230

যেভাবেই হোক স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমাকে করব দেবেন। আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তাই আমার লাশ বাংলাদেশের মাটিতে করব দেবেন।

 সে আরো বললো, স্যার গুলির আঘাতে আমার পেটের নাড়িভূড়ি বের হয়ে গেছে। আমার বাঁচার কোনই সুযোগ নেই।

 মুমুর্ষ দুলার করুণ কণ্ঠ শুনে সেদিন আমরা সাবই গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। সমস্ত হৃদয় আমাদের বিষাদে ভরে গিয়েছিল। আমরা আবেগ সংযত কণ্ঠে তাকে যতই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্ঠা করি সে তাতে শান্ত হয় না, সে তার অন্তিম মুহূর্তের আভাস পেয়ে শেষ মনের কথাটি আমাদের জানিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে বলতে থাকে, স্যার পাঞ্জাবী দস্যুরা যখন আমাদের বাঙ্গালীদের নির্মমভাবে, নির্বিচারে হত্যা শুরু করে তখন আমার ৮ বছরের মেয়েটি আমাকে কি বলেছিল জানেন? বলেছিল, আব্বা তুমিও মুক্তি ফৌজে যোগ দাও, পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, দেশকে স্বাধীন কর। আব্বা তুমি বাড়ি থেকে কি করবে? যদি দেশ স্বাধীন না হয় আমাদের অবস্থা কি হবে? তারা ত যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে।

 আমার হাত ধরে দুলা বলল, “স্যার আপনার বাড়ি কুমিল্লা, আপনি নিশ্চয় শালদা নদী চেনেন। সেখানে আমার বাড়ি। আমার এলাকার সবাই আমাকে চেনে। দয়া করে আমার মেয়েকে এবং সেই এলাকার কাউকে আমার মৃত্যুর খবরটা দেবেন না। আমার মৃত্যুর খবর পেলে আমার মেয়েটি বাঁচবে না। সে আমার জান। দয়া করে তার কাছে, স্যার আমার মৃত্যুর খবরটা গোপন রাখবেন। তবে আমার একটা দাবী, আমার হতভাগী মেয়েটিকে আপনি দেখবেন। স্যার আমার এই একটি কথা ভুলে যাবেন না।” কথা বলার মাঝে মাঝে একটা কথা সে ঘুরেফিরে বারবার বলছিল, “জয় বাংলা দেখে যেতে পারলাম না।”

 দুলার এই মুমূর্ষ অবস্থায় এ্যাম্বুলেন্স আসতে কিছুটা দেরী হবে মনে করে লে. কর্নেল শফিউল্লাহ তাকে নিজের জীপে করে আগরতলা পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমাদের মুক্তিফৌজের ডাক্তার আবুল হোসেনও দুলার সাথে হাসপাতালে গেলেন যাতে দুলা তার মনের ভরসা না হারায়। হাসপাতালে যাওয়ার পর দুলার অপারেশন করা হয় এবং যখন ডাক্তার জানালেন যে দুলার সঙ্কটাবস্থা কেটে গেছে তখন লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ হাসপাতাল ত্যাগ করেন।

 সেদিন দুলার সাথে আরো কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদেরকেও পাঠানো হলো।

 দুলার অবস্থা দেখে সেদিন আমার মত অনেকেই ধারণা করেছিল দুলা আর বাঁচবে না। কিন্তু আল্লার অসীম ক্ষমতা আমাদের মত ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে নিরুপণ করা অত্যন্ত কঠিন। তাঁরই অশেষ কৃপায় এবং অত্যন্ত করুণায় দুলা দেড় মাস পর আরোগ্য লাভ করল এবং পুনরায় ক্যাপ্টেন মোর্শেদের কোম্পানীতে যোগদান করল। পরবর্তীকালে অসীম বীরত্বের সংগে দুলা অনেক রণক্ষেত্রে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বাঙালীর বীর্যবত্তার ইতিহাস সমুজ্জ্বল করে তুলেছে।

 এবার বলছি আহাদের কথা। আহাদের বয়স মাত্র ১৫বছর। অতুলনীয় সাহসী ছিল এই বীর মুজাহিদ কিশোর। মুজাহিদ হিসেবে তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে তার বীরত্ব প্রদর্শণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল ঘটনা। দুলা ও আহাদের বীরত্বের সম্মানস্বরুপ লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল শফিউল্লাহ তাদেরকে ২৫০০ টাকা করে পুরস্কার প্রদান করেন।

 এর পড়ে আসে পুলিশ প্রসঙ্গ। আমার সঙ্গে যে ৫জন পুলিশ ছিলেন তারা হলেন মিজান, সুরুয মিয়া, খোরশেদ মিয়া, তাহের এবং কানু মিয়া। আমার কোম্পানীকে এরা মর্টার ছুড়তেন। মাত্র সামান্য কয়েকদিনের শিক্ষায় এরা মর্টার চালনায় প্রায় পেশাদার সৈনিকের মত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ৫জন পুলিশ সৈনিকের দান সামান্য নয়। অসীম বীরত্বের সঙ্গে এঁরা শত্রুসৈনিকের সাথে বারবার লড়াই করেছেন।