পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
232

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, লড়াইয়ের সে রাতগুলো ছিল খুবই অন্ধকার এবং ডিসেম্বর শীত-রাত্রির কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কিন্তু এই অন্ধকার ও কুয়াশার বাধা আমাদের জওয়ানদের পারেনি বিন্দুমাত্র হতোদ্যম করতে। একটার পর একটা স্থান দখলে আসাতে তারা ক্রমেই মানসিক দিক থেকে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং নব উন্মাদনায় দ্বিগুন শক্তিতে শত্রুদের আগাত হেনে পর্যুদস্ত করছিল। আখাউড়ার এক যুদ্ধে হতোদ্যম পাকিস্তানী সেনারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় এবং তাদের প্রচুর লোকসান স্বীকার করতে হয়। একজন শত্রুসেনা জীবিত অবস্থায় বন্দী হয় এবং ২০ জন হয় নিহত। এছাড়া মুক্তিফৌজের হস্তগত হয় হানাদার প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, রেশন, পোশাক-পরিচ্ছদ, ডিফেন্স স্টোর (প্রতিরক্ষা সামান্য)। আমাদের পক্ষ থেকে পাকবাহিনীর হাতে এই যুদ্ধে ইয়াসিন খাঁ নামে মুক্তিফৌজের একজন সিপাহী শহীদ হয়। তাকে সমাহিত করা হয় সিঙ্গারবিলে। তাছাড়া এই লড়াইয়ে মুক্তিফৌজের সিপাহী আবু জাফর, সিপাহী হুমায়ন, সিপাহী আবদুল লতিফ, হাবিলদার আকতার হোসেন, হাবিলদার মুফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, হাবিলদার নবীউল্লা এবং অপর একজন আহত হয়। পর্যুদস্ত শত্রুবাহিনী সাময়িকভাবে পিছু হটলেও ২রা ডিসেম্বরের সকালে আমাদের বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং সারাদিন ধরে খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে আমাদের বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আর্টিলারীর সহায়তায় মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে এই এলাকা শত্রুবাহিনী পুনর্দখল করে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর আমাদের বাহিনী সিঙ্গারবিলে গিয়ে জমায়েত হয়। এই যুদ্ধে শত্রবাহিনীরও অসম্ভব ক্ষতি সাধিত হয়। মুক্তিফৌজের নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী শত্রুর হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। অন্যান্য যারা আহত হন তারা হলেন সিপাহী 'আবদুল আউয়াল, হাবিলদার মাজু মিয়া, নায়েক নাসিরুজ্জামান, নায়েক আবদুস সালাম, সিপাহী মিজানুর রহমান।

 ৩রা ডিসেম্বর আমাদের বাহিনী নিজেদেরকে পুনর্গঠিত করে পাক বাহিনীর উপর পুনরায় আক্রমন চালায় এবং আজমপুর স্টেশন ও তার এক হাজার গজ অগ্রবর্তী স্থান দখল করে। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষের এগারজন সৈন্য নিহত হয়। আমদের পক্ষে দু'জন সিপাহী ও একজন নায়েক সুবেদার শহীদ হন। আমাদের বাহিনীর যখন যুদ্ধে লিপ্ত এমনি সময়ে আমরা খবর পেলাম পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। এবার আর যুদ্ধ কেবল বাংলাদেশ বাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত ভারত-বাংলাদেশ বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ডিসেম্বরের ৩/৪ তারিখ রাতে আমাদের বাহিনী পুনর্দখলকৃত এলাকাকে সুরক্ষিত করল। বলা বহুল্য, মুক্তিফৌজের অবিরাম আঘাতের পর আঘাত, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা মুক্তিবাহিনীর চাতুর্যপূর্ণ আতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন বেসামাল হয়ে পড়েছিল। এবার তারা সমস্ত দোষ ভারতের উপর চাপিয়ে ভরত আক্রমণ করে বসল।

 ৩রা ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে সেদিন অপরাহ্নে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ঐ দিন রাত্রি দ্বিপ্রহরে তিনিও ভারতের জওয়ানদের পাকিস্তানী হামলা প্রতিহত করার জন্য হুকুম দেন।

 অতএব মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হল ভারতীয় সোনাবাহিনীর হাত। সম্মিলিত বাহিনী ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, প্রচণ্ড গতিতে আক্রমণ করল অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে। বাংলাদেশের সীমানার চতুর্দিক দিয়ে যৌথ কমাণ্ডের অধীনস্থ সৈন্যদল ঢুকে পড়ল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

 এদিকে সামরিক সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সৈন্য মিত্রবাহিনীর নাম নিয়ে আখাউড়া যুদ্ধে নেমে পড়ে। আক্রমণ চালানো হয়েছিল অতি প্রত্যূষে। উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় আমাদের বাহিনীর পক্ষে খুব বেশি আর্টিলারী সাপোর্ট (কমানের সহায়তা) দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল মর্টারের প্রচুর সহায়তা। এই আক্রমণ শুরু করার আগে মেজর মতিনের নেতৃত্বে সেক্টর ট্রুপসের দুই কোম্পানী দিয়ে পাশ থেকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মেজর মতিনের ই-পি-আর কোম্পানী মারাত্মক