পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
233

প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র নড়েনি। আমাদের সেক্টরে ৪ঠা ডিসেম্বর যুদ্ধে মুক্তিফৌজের যে বীর সৈন্যরা শাহাদত বরণ করেন তাঁরা হচ্ছেন- লেঃ বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমিন, সিপাহী সিদ্দিকুর রহমান। যাঁরা আহত হন তাঁরা হচ্ছেন-সুবেদার চান মিয়া, হাবিলদার কামরুজ্জামান, কোম্পানী হাবিলদার মেজর নূরুজ্জামান এবং আরো ১৫ জন। এই লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিফৌজ ১৩ জন শত্রুসেনাকে হত্যা করে এবং ৪ জন শত্রুসেনা তাদের হাতে বন্দী হয়। মুক্তিফৌজ ছোটবড় হাতিয়ারসহ শত্রুবাহিনীর ৩২ টি রাইফেল কবজা করে।

 ডিসেম্বরের ৫ তারিখে পাকিস্তান বাহিনী আমাদের বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু আমাদের তীব্র-প্রতি-আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়ায় তুমুল লড়াই। এই লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী ও সংযুক্ত মিত্রবাহিনী অপরিসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী আখাউড়া দখল করে। ৪/৫ ডিসেম্বরের যুদ্ধে এই এলাকায় শত্রুবাহিনীর প্রায় ১৬০ জন সৈন্য মারা যায়।

 আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন শত্রুর অবস্থান ছিল খুবই সুদৃঢ়। ফলে এখানকার যুদ্ধ হয় ব্যাপক এবং মারাত্মক। বাংলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আখাউড়ার লড়াইয়ের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখানকার যুদ্ধে উভয় পক্ষই সর্বাধিকসংখ্যক আর্টিলারী ব্যবহার করে। কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্লাটা অক্রমণের মুখে পাঞ্জাবী সৈন্যরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় মিত্রবাহিনী আমাদের বাহিনীর সাথে যোগ দেবার পর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে তারা আর দাঁড়াতে পারেনি। বলাবহুল্য, আখাউড়ার পতনের পর শত্রুবাহিনী আর কোথাও ভালোভাবে অবস্থান নিতে পারেনি।

 আখাউড়ার যুদ্ধে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যেসব অফিসার অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেনঃ মেজর মতিউর রহমান, ক্যাপ্টেন মোরশেদ, লেফটেন্যাণ্ট ইব্রাহিম, লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ও লেফটেন্যাণ্ট সলিম (কোম্পানী অফিসার)।

 এখানে আমি ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোকপাত করতে চাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ছিল বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অন্যতম পুরনো ব্যাটালিয়ন। হানাদার পাক বাহিনী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর এই ব্যাটালিয়ন তখনকার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর শফিউল্লাহর (বর্তমানে কর্নেল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান) অধীনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মুক্তি সংগ্রামে এই ব্যাটালিয়নের অবদান অতুলনীয়।

 এখানে আখাউড়ার যুদ্ধে শাহাদাৎপ্রাপ্ত বীর সৈনিক লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করে তাঁর শহীদী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই।

 লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান রংপুর মিলিটারী কাস্টোডি থেকে পালিয়ে এসে ১৬ ই আগস্ট মনতলায় আমার সাথে যোগ দেন। আমি ১১ নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টএ যোগদানের আগ পর্যন্ত তিনি আমার অন্যতম প্লাটুন কমাণ্ডার হিসাবে আমার সাথেই ছিলেন। তিনি আমার সাথে বহু অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন।

 লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহসী সৈনিক। সদা হাসিমুখে এই অসম সাহসী যোদ্ধা যদিও মূলত ছিলেন একজন ক্যাভালরী অফিসার, তবু একজন ইনফ্যানট্রি অফিসারের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলেন না। যুদ্ধ চলাকালে শত্রুবাহিনীর একটি শেল তাঁকে আঘাত করে এবং সেই আঘাতে তিনি শহীদ হন। তাঁর মরদেহ আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে একটি মাজারের কাছে সমাহিত করা হয়। সিপাহী রুহুল আমিনের মরদেহও এরই কাছে সমাহিত করা হয়।