বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
236

অফিসারকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। এই সাব-সেক্টর ডিসেম্বরের দিকে ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত করে সিলেটের দিকে গিয়েছিল। এবং ভারত যখন যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন এই সাব-সেক্টর ভারতের ৫৯ ভারতীয় ব্রিগেডের সাঙ্গে সিলেটের প্রবেশ করেছিল।

 ৭। কমলাপুর সাব-সেক্টরঃ এটার কমাণ্ডার ছিল ক্যাপ্টেন এনাম। এই তরুণ অফিসার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং এই সেক্টরের সাব-সেক্টর কমাণ্ডার হয়ে অনেক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। ধলাই চা বাগান এবং পার্শ্ববর্তী চা বাগানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এই সাব-সেক্টরকে কৃতিত্ব দেয়া যায়। ভারত যুদ্ধ ঘোষণার পর এই সাব-সেক্টর ৮১ ভারতীয় ব্রিগেডের সঙ্গে মিলিত হয়ে মৌলভীবাজারে প্রবেশ করেছিল।

 লোহারবন্দ নামে এক জায়গায় সমস্ত ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত। রিলিফ ক্যাম্প, শরণার্থী শিবির এবং নানা জায়গা থেকে স্কুল-কলেজের ছেলেদের এবং বাংলাদেশের কর্মক্ষম নাগরিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হত। প্রশিক্ষণ দেবার পর ছেলেদের পাঠিয়ে দেয়া হত বিভিন্ন সাব-সেক্টর। এই কাজের জন্য সিলেটের ফরিদ গাজী, নূরুল ইসলাম, আজিজ, তোয়াবুর রহীম, ডক্টর আলী, হাবীব রহমান, ডক্টর মালেক, লতিফ প্রমুখ লোকের নাম না করলে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হবে। রাত-দিন কাজ করে নানা জায়গা থেকে লোক সংগ্রহ করে তাঁরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিতেন, আমার সৈন্যদের সাব-সেক্টর খাওয়া-দাওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করতেন, তার জন্য আমি তাঁদেরকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

 সেক্টর ট্রুপস -এর কাজ শত্রুদের ধ্বংস করা, এ্যামবুশ করা, এবং গণবাহিনীর কাজ ছিল পুল ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ সরবারাহ বিপর্যস্ত করা, মাইন পোঁতা ও ছোটখাটো শত্রুঘাটি ধ্বংস করা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক থেকে আমাকে দেয়া হয়েছিল যত চা-বাগান আমার এলাকায় আছে তাদের অকেজো করে দেওয়া। কাজ পুরোদমে চলতে লাগল। এদিকে একদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বিধু দাশগুপ্ত আমার কাছে এসে বলল যে, শিলং দিয়ে সুনামগঞ্জ এলাকায় অপারেশন করা উচিত। আমি তাদেরকে সব সাহায্য দিলাম। পরে এই দুই নির্ভীক যুবক তাদের নিজ নিজ এলাকার ভিতর ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিরাই অপারেশন এবং বিধু দাশগুপ্তের মাঘালকান্দী এবং আজমিরীগঞ্জ আপারেশন এলাকার সকলেরই সুবিদিত। এরা সত্যই প্রশংসার যোগ্য।

 মে-জুন সেক্টর ট্রুপস এবং গণবাহিনী তাদের নিজ নিজ কাজ পুরোদমে চালিয়ে যেতে থাকে। শেওলা-সাদা খাল, বারইগ্রাম এবং কাংলী ফেরীর উপর এরা আক্রমন চালিয়ে পাকিস্তানীদের বিপর্যস্ত করতে লাগল। অনেক দালালকে মেরে ফেলা হলো। ছোট ছোট দলে সেক্টর ট্রুপস ও বাহিনীকে পাঠানো হত ফেরীগুলোকে নষ্ট করতে। এক একটা নৌকাকে নষ্ট করতে বেশ সময় এবং পরিশ্রমের দরকার। এখনও মনে পড়ে নায়েব কুতুবের কথা। আজ সে আমাদের মাঝে নেই। সাদা খাল ফেরী নষ্ট করতে হবে। সংগে আরো দুজন সিপাহী ও দুজন ছত্র। সাদাখাল তখন পানিতে ভর্তি। বেশ স্রোত। কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল এখানে- ওখানে, খেয়া ছিল নদীর ওপারে, যেদিকে শত্রু ছিল। সবাই ওরা নদীতে নেমেছে খেয়াগুলিকে নষ্ট করতে। নদীর মধ্যখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মত গুলি আসতে শুরু করল। নায়েক কুতুব ডুব দিয়ে প্রায় নৌকার কাছে চলে এসেছিল। সামনে ছিল কচুরিপানা। ওগুলো মাথায় দিয়ে স্রোতের দিকে ভেসে গেল। দু দিন পর এসে আমার পায়ে প্রণাম করে বলল, বড় বেচেঁ গেছি স্যার। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ দিয়ে আনন্দে জল গড়িয়ে পড়ল, কেবল বললাম, বেঁচে থাক-জয় বাংলা' চারজন ফিরে এসে যখন অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিল তখন ভেবেছিলাম ওকে বোধ হয় আর ফিরে পাব না। যাই হোক ওকে আমার কাছে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

 পুরো জুন-জুলাই আমাদের কাজ অব্যহত থাকে। হিট এণ্ড রান কায়দায় শত্রুদের বিপর্যন্ত করাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। শত্রুদের ঘাঁটি লাটু, বড়লেখা, ফুলতলা, আটগ্রামের উপর হানা দিলাম। চা- বাগানগুলো অকেজো করতে আরম্ভ করলাম। রাজকী, ফুলতলা, শেওলা, পৃথিমপাশা, সমনভাগ, সোনারুপা,