পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
242

খুবই মশকিল হবে। কারণ ভারত থেকে ইতিমধ্যে গুর্খা ব্যাটালিয়ন এবং এফ-এফ-দের একটা কোম্পানী নিয়ে তামাবিল দখল করে দরবস্তে আমাদের সংগে মিলে সিলেটে একসঙ্গে যাব। যদি দরবস্ত দখল করতে না পারি তাহলে তাদের পক্ষে সিলেট থাকা মুশকিল হবে। তাই আজ রাতের মধ্যেই দরবস্ত দখল করতে হবে। শুরু হল আমাদের অভিযান। গ্রামের নামটা মনে নেই, প্রায় দেড় মাইল দূরে এসেছি। বাঁয়ে সদ্য ফেলা মাটির একটা উঁচু টিলা। মনটা ভাল লাগল না। পাশেই বেশ কয়েকটা বাড়ি ছিল। একজন বুড়ো ভদ্রলোককে ডাকলাম। সে আমাকে দেখে কেঁদে উঠল। কিছুদিন আগের একটা ঘটনা। ৭/৮টা পাকিস্তানী এসেছিল ওদের গ্রামে, সঙ্গে ছিল বাঙ্গালী রাজাকার। সমস্ত গ্রামটা তছনছ করে দিয়েছিল। ওদেরকে খাবার দিতে হবে। যা অল্পবিস্তর খাবার ছিল দেয়া হয়। হালের গরুটাকেও ওরা ছাড়েনি। ওদেরই বাড়িতে রান্নাবান্না হল। খাওয়া শেষ হল। রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল। চারিদিক অন্ধকার। ঘরের ভেতরে মেয়েছেলেরা ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। হঠাৎ ২/৩টা সৈন্য ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করল। ওরা সবাই নিষেধ করল। শুরু হল অমানুষিক মারধর। এমনিভাবে চার-পাঁচটা বাড়িতে হামলা করলো। মেয়েদের উপর অকথ্য নির্যাতন করলো। চারপাশের বেশ কয়েকজন জোয়ান ছেলেকে উঁচু জায়গায় নিয়ে গেল। ওদেরকে দিয়ে মাটি কাটানো হল। তারপর শোনা গেল বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজ এবং সাথে সাথে আর্তনাদ। সবশেষে ডাকা হল বাকি যারা ছিল ওদেরকে মাটি দিয়ে গর্ত ভরতে। যারা বুড়ো ছিল চোখের পানিতে নিজের ছেলের কবর দিতে লাগল। এই হল রাস্তার পাশে ছোটটিলার ইতিহাস। চোখ ভরে পানি এল। প্রতিহিংসার তীব্র জ্বালা মনে এল। প্রতিশোধ নিতেই হবে।

 দরবস্ত এখনো অনেক দূরে। দূরে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম না এই গোলাগুলির আওয়াজ কিসের। আন্দাজ করলাম ভারতীয় সৈন্যদের সাথে পাকিস্তানীদের কাছাকাছি কোথাও যুদ্ধ চলছে। দেরী করলে চলবে না, আজকে রাতের মধ্যেই আমাকে দরবস্ত দখল করতে হবে। রাত প্রায় বারটা হবে। এফ-এফ রবের কাছ থেকে খরব পেলাম ওদের উপর গোলাগুলি আসছে। রবের সৈন্যদের দরবস্তকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে এবং এফ-এফ শুকুরকে দরবস্তের বাঁ দিকে ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হল। মেজর রবের কোম্পানী রাস্তার ঠিক বাঁয়ে এবং সুবেদার ফজলুল হকের কোম্পানী রাস্তার ডানদিক দিয়ে সোজা দরবস্তের উপর আক্রমণ করবে। দরবস্ত তখন প্রায় তিন মাইল দূরে। বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল। রব এবং শুকুরের সঙ্গে আমার বেতার যোগাযোগ ছিল না। মেজর রব এবং ফজলুল হকের কাছ থেকে খবর পেলাম যে রব এবং শুকুরের সাথে তাদের কোন যোগযোগ নেই, তবে তারা দরবস্তের কাছে পৌঁছে গেছে।

 ৭ই ডিসেম্বর সকাল চারটা। মেজর রব এবং ফজলুল হক খবর দিল যে দরবস্ত দখল হয়ে গেছে। মেজর রব এবং সুবেদার ফজলুল হকের সৈন্যদের বিশ্রাম নিতে বললাম। যখন একটু বেলা হয়ে যাবে তখন যেন ওরা এক-একটা করে প্লাটুন পাঠিয়ে দেয় রব এবং শুকুরের সৈন্যদের খুঁজে বের করতে। সকাল প্রায় ৭টা। দেখছি, দু'ধার থেকে এফ-এফ রব এবং এফ-এফ শুকুরের সৈন্যরা এসে আমদের সাথে একত্রিত হচ্ছে। এফ-এফ রবের কাছ থেকে জানলাম ওরা যখন পাকিস্তানীদের পেছনে ধাওয়া করছিল তখন ওরা দিক হারিয়ে অনেক ডানে চলে গিয়েছিল, এবং পরে একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তবে কোন পাকিস্তানীকে পায়নি। এফ- এফ শুকুরের খবরে জানলাম পাকিস্তানীরা রাতের অন্ধকারে হরিপুরের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছিল। ওদেরকে পিছু ধাওয়া করতেই ওরা অন্য পথে চলে গিয়েছিল। তারাও একটা গ্রামে আস্তানা গেড়েছিল। ওখানেও গ্রামের বাড়িতে একটা পাকিস্তানী সৈন্য লুকিয়েছিল, তাকেও শেষ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারতের গুর্খা সৈন্যরা ৫নং সেক্টরের একটি কোম্পানী নিয়ে দরবস্ত পৌঁছেছে।

 ৮ই ডিসেম্বর, বেলা প্রায় দশটা হবে। একদিনের জন্য দরবস্তে আমার আস্তানা গেড়েছি। ব্রিগেডিয়ার ওয়াদকে এবং ব্রিগেডিয়ার বার্নে এসে দরবস্তে পৌঁছলেন। ঠিক হল গুর্খা রেজিমেণ্ট রাস্তার ডান পাশ হয়ে দরবস্ত-সিলেট যাবে এবং আমার সৈন্যরা রাস্তার বাঁদিক দিয়ে খাদেমনগর হয়ে সিলেট যাবে।

 ১০ই ডিসেম্বর পৌঁছলাম লামা নামক একটা গ্রামে। ব্রিগেডিয়ার ওয়াদকের সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন, হিমু চা বাগানের কাছে পাকিস্তানীরা শক্ত ব্যূহ রচনা করছে। একটা পুল আছে হিমুর কাছে। তার নিচে দিয়ে