পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
289

আসলেন এবং আমরা সপ্তাহখানেক পর্যন্ত ট্রেনিং পরিচালনা করলাম। আর পুরো এলাকাটা যতটুকু সম্ভব ‘রেকি’ করলাম। আমাদের ক্যাম্পটি ছিল ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরে। এটা বাংলাদেশের ভেতরেই ছিল ইণ্ডিয়ার বর্ডার থেকে প্রায় ৭ মাইল ভিতরে। ঐ এলাকাটাতে পাকিস্তান আর্মি তখনো আসে নাই।

 গৌরী নগর গ্রামে অবস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮ই অক্টোবর রাতে দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে ২৫টি দেশী নৌকাযোগে গৌরীনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আগের দিনই ঐ গ্রাম রেকি করে এসেছিলাম। কিন্তু রেকি করে আসার পরই পাকসেনারা যে ঐ গ্রামে অবস্থান নিয়েছিল, সে খবর জানা ছিল না।

 ১৮ই অক্টোবর নৌকাযোগে গৌরীনগরের কাছাকাছি হতেই পাকসেনারা বেপরোয়াভাবে গৌরীনগর থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। অকস্মাৎ এই আক্রমণের জন্য আমরা আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। ২৫টি নৌকাভর্তি আমাদের বাহিনী নদীপথে রাতের দিক হারিয়ে ফেললো। এ অবস্থায় অনেক চেষ্টার পর আমি আমার বাহিনী নিয়ে সরে এসে বর্নি নামক স্থানে অবস্থান নিলাম। গৌরী নগর গ্রামে পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড গোলার মুখে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৬ জন গুরুতররূপে আহত হয়।

 বর্নিতে সুবেদার মোশাররফ এবং এফ-এফ মাহবুবের কমাণ্ডে কোম্পানী দু'টি রেখে আমি হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলাম। বর্নিতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণের মুখে সুবেদার মোশাররফ এবং এফ-এফ মাহবুব তার বাহিনী নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পিছু সরে ডাকাতের বাড়ি এবং দলিরগাঁও-এ পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বর্নির সংঘর্ষে পাকসেনাদের হাতে বন্দী এবং বেশকিছুসংখ্যক যোদ্ধা আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই বিপর্যয়ে ২২/২৩শে অক্টোবর আমি সেক্টর কমাণ্ডার শওকতের নির্দেশে ২০০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভোর পাঁচটায় বর্নিতে পাক অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাই। বাঁদিক থেকে আমার বাহিনী এবং ডানদিক থেকে সুবেদার মোশাররফের বাহিনী তীব্রভাবে আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনী বর্নিতে ঢুকে পড়ে। পাকসেনারা ফ্রণ্ট লাইন ছেড়ে পিছনে সরে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানীরা বিপর্যয় অবস্থা কাটিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। তাদের তীব্র আক্রমণের মুখে আমাদের বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এই সময় আমি সেক্টর কমাণ্ডারের কাছে অয়ারলেসযোগে বার বার সাহায্য প্রার্থনা করি। এই বার্তা পেয়ে সেক্টর কমাণ্ডার শওকত মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুনকে অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে পাঠালেন। এই প্লাটুনটি পৌছানোর ফলে আমাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায় এবং পাকিস্তানীদের উপর তীব্রভবে আক্রমণ চালাতে থাকি। বেলা ৪টা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা চরম ক্ষতি স্বীকার করে বর্নি ছেড়ে গৌরীনগরে পালিয়ে যায়। আমাদের বাহিনী বর্নিতে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

 এরপর মুক্তিবাহিনী বর্নি থেকে আমার কমাণ্ডে অগ্রসর হয়ে ৩০শে অক্টেবর পাক ঘাঁটি গৌরীনগর আক্রমণ করে। এফ-এফ মাহবুবও তার বাহিনী নিয়ে এলেন। সংঘর্ষে ১৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিলো। সেক্টর কমাণ্ডার মীর শওকত স্বয়ং ১২০ মিলিমিটার মর্টার দ্বারা সাহায্য করলেন। আমাদের বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকবাহিনীর প্লাটুনটি এবং রাজাকার বাহিনীর একটি কোম্পানী পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী গৌরীনগর পৌছে যায়। গোলাগুলির শব্দে সালুটিকার থেকে পাকিস্তানীদের একটি সাহায্যকারী শক্তিশালী দল চলে আসে এবং আমাদের উপর প্রচণ্ডভাবে পাল্টা আক্রমণে আমাদের গৌরীনগর ছেড়ে দিতে হয়। এই ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ২ জন আহত হয়। অপরদিকে পাকসেনাদের ১১ জন হতাহত হয় বলে জানা যায়।

 নভেম্বরের শেষের দিকে লামনিগাঁও-এর সংঘর্ষে লেঃ হোসেন ৩য় বেঙ্গলের একটি প্লাটুন নিয়ে বেশ বিপদে পড়ে যান। পাকিস্তানীরা লামনিগাঁও-এ লেঃ হোসেনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছিল। এই সংবাদ পৌছলে আমি তৎক্ষণাৎ আমার বাহিনী নিয়ে লামনিগাঁও-এর দিকে অগ্রসর হই। পথে পাকিস্তানীরা এ্যামবুশ করে। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে পাকিস্তানীদের পক্ষে ২ রাজাকার বন্দী এবং কয়েকজন হতাহত হয় এবং বাকী