পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
299

 এখানে বলে রাখা ভাল যে, যে সমস্ত টাকা-পয়সা কুড়িগ্রাম এবং ঠাকুরগাঁও ব্যাঙ্ক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে এসেছিল সে সমস্ত টাকা সীলমোহর করা বাক্সে মুজিবনগরে বাংলাদেশের সরকারের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। সে টাকা কিভাবে খরচ করা হয়েছে তা বলতে পারছি না। তখন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীতে শরনার্থী শিবির থেকে নিয়োগ করত এবং ট্রেনিং দিচ্ছিল। শরনার্থী শিবিরগুলোতে অধিকাংশ হিন্দু ছিল। তারা তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং-এর জন্য পাঠাত। এ ব্যাপারে আমাদের কোন কর্তৃত্ব ছিল না। কিন্তু সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমি এ ব্যাপারে ওদের সাথে আলাপ-আলোচ না করি এবং তাদেরকে বলি যে রিক্রুটমেণ্ট আমরা করব। আপনারা আমাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র এবং ট্রেনিং এর ব্যাবস্থা করবেন। অপারেশনে পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের থাকবে। অনেক বাকবিতণ্ডার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্মত করানো হয়। সৌভাগ্যবশত ভারতে আমাদের যে ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল (মূর্তি টি এস্টেট) সেখানকার কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল সেনগুপ্ত ছিলেন একজন বাঙ্গালী হিন্দু। তিনি আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ব্রিগেডিয়ার জোসীও আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য এবং সহানুভূতি দেখিয়েছেন।

 সেনগুপ্ত ট্রেনিং-এর চার্জে ছিলেন। সীমান্ত এলাকায়, যারা বাংলাদেশের ভেতর থেকে ট্রেনিং-এর জন্য আসত তাদেরকে প্রথমে হোল্ডিং ক্যাম্পে রাখা হত, তারপর কেন্দ্রীয় একটা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ৩ সপ্তাহের গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হতো। পরে এদেরকে আমার কাছে পাঠানো হত বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানোর জন্য। এবং আমার মনে হয় সমস্ত সেক্টরে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছিল।

 তিন সপ্তাহের ট্রেনিং যথেষ্ট ছিল না। তাই ঠিক করা হল গেরিলাদের নিয়মিত বাহিনীর সাথে আরো ১৫ দিন রাখার এবং যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে ট্রেনিং দেয়ার। এ সময়ের মধ্যে আমরা কাকে কোন দলের নেতৃত্ব দেয়া যায় তা ঠিক করতে পারতাম। তারপর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় ছেলেদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে ভিতরে পাঠিয়ে দেয়া হত শত্রুর অবস্তানের কাছে গিয়ে রেকি করার জন্য। তারপর তাদেরকে অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেয়া হত।

 শত্রুর অবস্থানের আশেপাশে আমাদের গেরিলা বেইসগুলো ছিল। আমার সেক্টরে প্রায় ১২০টার মতো গেরিলা বেইস ছিল। প্রত্যেকটি গেরিলা বেইস থেকে কুরিয়াররা প্রতি সপ্তাহে এসে আমাদের কাছে অপারেশন-এর খবর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন খবরাখবর দিয়ে যেত। কোন কোন সময় নিয়মিত বাহিনী নিয়েও শত্রুর অবস্থানগুলোতে আক্রমণ চালাতে হত। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে আমরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতাম।

 মেজর নওয়াজেশ সাব-সেক্টর কমাণ্ডার (রংপুর) ছিলেন-ভূরুঙ্গামারী থেকে পাটগ্রাম পর্যন্ত। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ছিলেন মোগলহাটে। ক্যাপ্টেন মতিউর ছিলেন বাউরাতে। চিলাহাটিতে ছিলেন ফ্লাইট লেঃ ইকবাল। ক্যাপ্টেন নজরুল ছিলেন হলদীবাড়িতে। সুবেদার মেজর ওসমান গনি (ই-পি-আর), স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন-ইনডাকশন ট্রেনিং শেষ হবার পর বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানো এদের দায়িত্ব ছিল।

 দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অমরখান নামক জায়গায় আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। রংপুর জেলার বড়খাতায় আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। ভূরুঙ্গামারীর নিকটে আমাদের আর একটা প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। এখানে মেজর নওয়াজেশ ছিলেন। বড়খাতায় ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। অমরখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারী নামক জায়গায় (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে)। আমাদের নিয়মিত বাহিনী নিতান্ত নগণ্য ছিল, সুতরাং আমাদেরকে হ্যারাসিং ফায়ার, রেইড, এ্যামবুশ, মাইন পুঁতে রাখা এগুলোর উপর জোর দিতে হয়েছিল।