পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
300

 প্রধান আক্রমণ যে সমস্ত জায়গায় চালানো হয়েছিল সেগুলো হলঃ ভূরুঙ্গামারী (রংপুর), মোগলহাট (রংপুর), অমরখান (দিনাজপুর), বড়খাতা (তেঁতুলিয়া), এবং পাটগ্রাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গের থাকার জন্য দুটো ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের পুরো সেক্টরের জন্য দুজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন। তেঁতুলিয়াতে ৫০ বেডের একটা হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। ডাক্তার আতিয়ার রহমান (পঁচাগড় চিনিকলের ডাক্তার) তেঁতুলিয়া হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। বুড়িমারীতে ২৫ বেডের একটা হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হোসেন এখানে ছিলেন। দুজন ছাত্র ফ্রণ্টে ছিল। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম এদের কাছে পাঠানো হত। এরা ছোটখাট অস্ত্রোপচার করত এবং প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হত। রংপুর কলেজের কয়েকজন ছাত্রী হাসপাতালে নার্সিং ডিউটি করার জন্য তাদের ভলাণ্টিয়ার করে। মারাত্মকভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাগডোগরা কম্বাইণ্ড মিলিটারী হাসপাতালে এবং জলপাইগুড়ি বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হত। ঔষধপত্র যন্ত্রপাতি ভারতীয় সামরিক বাহিনী থেকে পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সূত্রে যোগাড় করেছিলেন। স্থানীয় ভারতীয়রাও সাহায্য করেছিলেন। জুলাই-আগষ্ট থেকে খাদ্যদ্রব্য, কাপড়চোপড়, ঔষধপত্র, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ আগের থেকে নিয়মিত ছিল। যদিও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না, তবুও মুক্তিযুদ্ধের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকল। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকেও ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিতভাবে আসতে থাকল। এই সময় বিভিন্ন সেক্টরে অফিসারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার মূর্তিতে অফিসারদের ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখানে প্রথম ব্যাচে প্রায় ৬৪ জন অফিসার ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন। এখানে পাসিং আউট প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। এই পাসিং আউট প্যারেড-এর খবর পাকিস্তানে গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে চলে গিয়েছিল।

 এই সময় বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আমার সেক্টরে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, এবং চারদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের বিভিন্ন অবস্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। তিনি তেঁতুলিয়া, ভজনপুর, পাটগ্রামে জনসভায়ও ভাষণ দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। জনাব কামরুজ্জামান যখন আমাদের সেক্টর পরিদর্শনে আসেন তখন তিনি তার মন্ত্রণালয় পাটগ্রামে স্থানান্তরিত করার সিধান্ত নিয়েছিলেন। সমস্ত সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর লোকেরা ৭৫ টাকা করে মাসিক পকেট খরচ এবং খাদ্য, কাপড়-চোপড় পেতো। অফিসাররা ২০০ টাকা করে পেতো এবং গেরিলারা পেত ৫০ টাকা করে পকেট খরচ এবং ফ্রি রেশন এবং অথবা দু'টাকা করে প্রত্যহ রেশন মানি।

 অমরখানাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল- তাদের ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়া বাহিনী মিলে প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য ছিল। জুলাই মাসে টাস্ক ফোর্স দুই কোম্পানী এবং এক কোম্পানী ফ্রিডম ফাইটার নিয়ে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। শত্রবাহিনীর পেছনে গেরিলাদের অনুপ্রবেশ করানো হয় ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে। দুই কোম্পানী ই-পি-আর সৈনিকদের সাহায্যে প্রধান আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীরও সাহায্য নেয়া হয়েছিল। যদিও শত্রুঘাঁটি আমরা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম কিন্তু পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের ফলে আমাদেরকে ঐ স্থান ত্যাগ করতে হয়।

 এই ব্যর্থতা থেকে আমরা কতগুলো শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম। আক্রমণের পূর্বে শত্রুবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। রেডিও বা অয়ারলেসে যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। সৈনিকদেরকেও ভালভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর যদি পূর্বাহ্নেই পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান জানতে পারতাম তাহলে ঐ অবস্থানের উপর শেলিং করা যেত।