পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
309

 দ্বিতীয় অপারেশনঃ রংপুরের ভূরুঙ্গামারী জয়মনিরহাট রায়গঞ্জ অপারেশন। যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে করে পাকবহিনী কুড়িগ্রাম থেকে ধবলানদী অতিক্রম করে রসদ, গোলাবরুদ এবং সৈন্য পাটেশ্বরী, নাগেশ্বরী এবং ভুরুঙ্গামারীর দিকে সরবরাহ না করতে পারে সে জন্য এই অপারেশন চালানো হয়। এই অপারেশনে ভুরুঙ্গামারীতে মেজর নওয়াজেশ তার দল নিয়ে আক্রমণ করেন আর আমার দলের দুটো গ্রুপের একটা ছিল পাটেশ্বরী এবং অপরটি ছিল নাগেশ্বরীতে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঈদের রাতে এই অপারেশন চলে। এই অপারেশনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ১০/১২ জন সদস্য শহীদ হন, অপরদিকে পাকসেনাদের কমপক্ষে সোয়শ' সেনা নিহত হয়। এই অপারেশনেও আমরা সাফল্য অর্জন করি। এই অপারেশনে ১ জন অফিসারসহ ১০ থেকে ১৫ জন পাকসেনা ধরা পড়ে এবং ২ জন অফিসার নিহত হয়।

 ৩য় অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং তিস্তাঘাটের মধ্যবর্তী বড়বাড়ি ইউনিয়নে পাকবাহিনীর আরেকটি ঘাঁটি ছিল। নভেম্বরের ১০ তারিখের সন্ধ্যায় এই ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। আমার বাহিনীর মাত্র ৬০ জন সদস্য নিয়ে আমি নিজে এই ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের তীব্র আক্রমণের ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বাকীরা পালিয়ে যায়। আমরা ওদের রান্নার কাজে সহযোগিতাসহ আমাদের খবর সরবরাহকারী তাদের পাচক এবং সেই ক্যাম্পে যে মহিলাকে নিয়ে পাকসেনারা রাত কাটাতো তাকেও ধরে নিয়ে আসি। এই অপারেশনে আমাদের ৪/৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক ভাবে আহত হয়। পূর্বোল্লিখিত আমার বাহিনীর ২-এম দল তিস্তাঘাট এবং তার আশেপাশে ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই পাক-সেনাদের অবস্থানগুলোয় আক্রমন চালায় এবং তাদের সফল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে তারা রংপুর হেডকোয়ার্টারে কেন্দ্রীভূত হয়। এছাড়া ২-এম দলও পীরগাছা থানা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোর ঊর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায়। তাদের সে আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী কুলাতে না পেরে পীরগাছা ছেড়ে রংপুরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এইসব আক্রমণে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হই। এসব আক্রমণে বিপুলসংখ্যক রাজাকারও নিহত হয়। প্রসঙ্গতক্রমে আরো উল্লেখ্য যে, এরা ছিল পাকবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ এলাকার আক্রমণকারী।

 সীমান্ত এলাকা থেকে দীর্ঘ ৬৫ মাইল ভিতরে আমার বাহিনীর ১-পি দল মিঠাপুকুর থানার রানীপুকুরে শত্রুবাহিনীর উপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। তারাও ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই শত্রুবাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে তোলে এবং তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। তাদের হাতেও অনেক রাজাকার নিহত হয় এবং আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে ১০ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই সমস্ত এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এরপরে ক্যাপ্টেন মতিউর রহামন পাটগ্রাম থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন এবং আমি আমার বাহিনী নিয়ে লালমনিরহাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। ডিসেম্বরের ১১/১২ তারিখের দিকে আমরা তিনজন নিজ নিজ দলসহ লালমনিরহাটে মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি এবং ১৪ই ডিসেম্বরে রংপুর শহরে পৌঁছে রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকি। বিকেলে মিত্রবাহিনীও রংপুর পৌঁছে এবং তারা আমাদেরকে ক্যাণ্টনমেণ্টে আক্রমণ স্থগিত রাখার অনুরোধ জানান। তাঁরা ইতিমধ্যে মেসেজ পেয়েছিলেন যে রংপুরস্থ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে এবং সেজন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমণ থেকে বিরত হই। আমাদের রংপুর পৌঁছার খবর পেয়ে সেখানকার জনগণ ও আশেপাশের গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আগত সাধারণ মানুষ আমাদেরকে এবং মিত্রবাহিনীকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেন। তাদের বিজয়োল্লাস এবং আমাদের প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ও প্রাণবন্ত সংবর্ধনায় আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি।

স্বাক্ষরঃ এম, দেলোয়ার হোসেন
১৬-১০-৭৪