পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
312

ডিফেন্সের উপর নিক্ষিপ্ত হয়। পাক-বাহিনী ২৮ তারিখ রাতে পঁচাগড় ছেড়ে ময়দান দিঘীতে ডিফেন্স নেয়। ঐ রাতের যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর ২৫০ জনের মত হতাহত হয়। এখানে পাক বাহিনীর ২শত জনের মত হতাহত হয়। ২৭ জন পাক-সেনাকে জীবন্ত ধরে ফেলা হয়। প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ৮টি গাড়ী উদ্ধার করা হয়। পঁচাগড় যুদ্ধ মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবহিনীর বাংলাদেশের ভিতরে বৃহৎ যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম।

 ৩০ তারিখ দিনের বেলায় বোদা থানার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বেলা তিনটার সময় পুটিমারী নামক স্থানে দুশমন আমাদের অগ্রগতি প্রতিহত করে। ফলে আমরা সেখানে ডিফেন্স নিতে বাধ্য হই।

 ৩১ তারিখ ১২টায় আমরা পাকবাহিনীর উপর আক্রমন চালাই। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর ৫ জন ও ভারতীয় বাহিনীর ৫৫ জন হতাহত হয়। পরে আমরা ময়দানদীঘি দখল করে ফেলি। বিকালে আমরা বোদার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পাকবাহিনী বোদাতে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমরা বাধ্য হয়ে বোদা থানার ১ মাইল দূরে ডিফেন্স নেই। বিকালে বোদা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করি। এখানে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের ভীষণ যুদ্ধ হয়। এখানে ভারতীয় আর্টিলারীর ক্যাপ্টেন সুধীর নিহত হয়। সন্ধ্যায় বোদা থানা আমাদের দখলে আসে। পাকবাহিনীর ৬০/৭০ জন হতাহত হয়। ভারতীয় বাহিনী বোদাতে এসে বিশাম নেয় কিন্তু মুক্তিবাহিনী বোদা থেকে তিন মাইল সম্মুখে ঠাকুরগাঁয়ের পথে ডিফেন্স নেয়। সেদিন রাতে ভুলে মিস ফায়ার হয়। তাতে ভারতীয় ২০/২৫ জন জোয়ান হতাহত হয় এবং আমাদের খাদ্য ও রান্না বহনকারী পার্টির ৪/৫ জন নিহত হয়। এ রাতেই ভারতীয় কোম্পানীর সহিত মুক্তিবাহিনীর ৪০ জন জোয়ানকে পাঠাই। তারা ভুলিরপুলের নিকটে গেলে পাকবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তখন ভারতীয় বাহিনীও তাদের পাল্টা জবাব দেয়। পাক সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে তাহারা ভুলির ব্রীজ নষ্ট করে পিছনে হটে। ১লা ডিসেম্বর আমরা ব্রীজ থেকে ২ মাইল দূরে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকি। ভারতীয় বাহিনী তখন ব্রীজ মেরামত করে।

 ৩রা ডিসেম্বর আমরা সম্মিলিত বাহিনী ঠাকুরগাঁও দিকে অগ্রসর হই। এই সময় পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁ ত্যাগ করে। ঠাকুরগাঁতে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের কোন সংঘর্ষ হয় নাই। ঐ দিনই আমরা ঠাকুরগাঁও দখল করে ঠাকুরগাঁও থেকে আরো তিন মাইল সম্মুখে অগ্রসর হই। ৪ তারিখে আমরা বটতলী নামক স্থানে ডিফেন্স করি। ৫ তারিখ সারাদিন পাকবাহিনীর পুতে রাখা মাইন উঠাই। ৬ তারিখে আমরা বীরগঞ্জ আক্রমণ করি। পাকবাহিনীর সহিত আমাদের বহু সময় যুদ্ধ চলে। শেষে পাকবাহিনী বীরগঞ্জ ছেড়ে পিছনে হটে। এখানে ভারতীয় বাহিনীর ১০/১২ জন জোয়ান নিহত হয়। ৭ তারিখে আমরা সম্মিলিত বাহিনী ভাতগাঁও ব্রীজের দিকে রওনা হই। পাকবাহিনী তখন ভাতগাঁও ব্রীজ নষ্ট করে রাস্তার দু পাশে মাইন পুঁতে রেখে পিছনের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তখন ভাতগাঁও ব্রীজের চারপাশ থেকে মাইন তুলতে শুরু করি।

 ৯ তারিখে আমাদের দুটি কোম্পানী ও ভারতীয় দুটি ব্যাটালিয়ন দিনাজপুর আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। দিনাজপুরের নিকটে গিয়ে কাঞ্চন নদী পাড় হয়ে আমরাও দিনাজপুর আক্রমণ করি। এখানে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের অনেকক্ষন যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর ৩০/৩৫ জন নিহত ও ১০/১২ জন নিখোঁজ হয়। পরে আমরা সেখান থেকে পিছনে হাঁট। ফেরার পথে দশ মাঙ্গল নামক স্থানে পাকবাহিনীর আর একটি ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করি। এখানে আমরা ২৩ জন পাকসৈন্যকে জীবন্ত ধরে ফেলি এবং প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি সরে পড়ি। কারণ পাকবাহিনীর কয়েকটি ট্যাংক পিছন থেকে আসছিল।

 ১০ তারিখে ভারতীয় দুটি ব্যাটালিয়ন সৈন্য পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে, কিন্তু এখানে পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণে তারা আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ১৫০ জন জোয়ান মারা যায়। পরে পাকবাহিনী পিছনে হটে। তখনও আমাদের হেডকোয়ার্টার বীরগঞ্জেই ছিল। ইতিমধ্যেই হিলি থেকে আমাদের বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী হিলি দখল করে দিনাজপুরের নিকট এসে পড়ে।