পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
316

করিলেন। কোম্পানীর নাম দেওয়া হইল 'ডি' এবং সুবেদার আবুল হাশেমকে সেই কোম্পানীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হইল। নূতন কোম্পানীর কিছু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল, তাই কয়েকদিন তাহারা ডিফেন্সের পিছনে থাকিয়া তা সমাপ্ত করিল। ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর কর্মতৎপরতা বাড়িয়া উঠিল। তাহাদের সাথে আমাদের ছোটখাটে সংঘর্ষ হইল। এরপর প্রধানপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া ও নুনিয়াপাড়া নামক গ্রামে তাহারা হঠাৎ আমাদের উপর বড় রকমের আক্রমণ চালায়। ইহাতে আমাদের কিছু লোক আহত ও শহীদ হইলেন। ‘এ’ কোম্পানী যেটা উক্ত এলাকায় ছিল প্রায় ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। কিন্তু তাহার সুযোগ্য অধিনায়ক সুবেদার হাফিজ একদিনের মধ্যেই সমস্ত কোম্পানীকে একত্র করতঃ আরও শক্ত করিয়া ডিফেন্স নিলেন। তারিখটি ছিল ২৮শে জুলাই। দিন কয়েক পর পাকিস্তানীদের কয়েকটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি- যাহা চাওই নদীর তীরে ছিল- তাহাতে আমরা প্রচণ্ড আঘাত হানি। তাহাদের অনেক হতাহত হয়। আমরা কিছু হাতিয়ার ও গোলাবারুদ কব্জা করি। এরপর ঘন ঘন ছোটখাটো আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ বেশ কয়েক দফা হইয়া গেল। আমাদের নিয়মিত ফাইটিং পেট্রল পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাইয়া বহু হতাহত করিতে লাগিল। এমন একটি দিন ও রাত বাকী থাকিত না যে, পাকিস্তানীরা আহত ও মৃত সৈন্য নিবার জন্য পাল্টা আক্রমণ ও কভারিং ফায়ার না করিত। এইদিকে আমাদের নবগঠিত 'ডি' কোম্পানীও পজিশনে আসিল এবং সবাই মিলে আরও এক মাইল অগ্রসর হইয়া পজিশন নিল। পাকিস্তানীদের বিতৃষ্ণার সীমা রহিল না কিন্তু সংখ্যা তাহাদের পূরণ হইতে থাকিত পিছনে হইতে নিয়মিত সৈন্য আমদানী করিয়া। এই পর্যায়ে একদিন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয়বারের মত আমাদের সাব সেক্টরে যান এবং ফিল্ড হেডকোয়ার্টার দেবনগরে শুভাগমন করতঃ বিভিন্ন অগ্রবর্তী ঘাঁটি পরিদর্শন করিয়া আমাদের জোয়ানদেরকে উৎসাহিত করেন।

 আমাদের কর্মতৎপরতা দেখিয়া কর্তারা খুশী হইলেন এবং গোলাবরুদ ও গোলন্দাজ সাহায্য নিয়মিতভাবে দিতে লাগিলেন। এইদিকে আমাদের মর্টার প্লাটুনও গোলাবারুদ পাইয়া গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী অবস্থানসমূহের উপর সুযোগমত বার বার গোলাবর্ষণ করিয়া তাহাদের মনে ভীতির সঞ্চার করিয়া দিল। আমাদের সাব-সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা বাড়িল, হাতিয়ার বাড়িল, গোলাবরুদ বাড়িল, শক্তি এবং মনোবল আরও দৃঢ় হইল, কর্মতৎপরতা এবং রণনৈপুণ্যে পাকিস্তানীরা পরাজিত হইতে লাগিল, কিন্তু পূর্ণতার জন্য আরো কিছু প্রয়োজন ছিল, আরও প্রশিক্ষণ ও কলাকৌশল দরকার ছিল। তাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার একখানা ছোট বই ছাপাইয়া তাহার কপি সবাইকে দিলেন। তাহাতে সব নূতন-পুরাতন হাতিয়ারের যাবতীয় বিবরণ ও ব্যবহার পদ্ধতি সুন্দরভাবে লিখা ছিল। তাহাতে আরও ছিল বিভিন্ন ধরনের খবরাখবর ও উৎসাহের কথা, যাহা যুদ্ধের প্রয়োজনে জানা নেহায়েত দরকার। এইভাবে কাজের ও যুদ্ধের ফাঁকে অসুবিধা সত্ত্বেও চারিদিকে প্রশিক্ষণ চলিতে লাগিল। আমাদের ক্যাপ্টেন শ-খানেক উৎসাহী গ্রাম্য ছেলে ভর্তি করিলেন, যারা ছিল অত্র এলাকার বাসিন্দা। তাহাদের একমাস প্রশিক্ষণ দিবার পর চারটি কোম্পানীতে ভাগ করিয়া দেওয়া হইল, যাহাতে রাজাকার ও অন্যান্য দালাল ধরিয়া দিতে অসুবিধা না হয়। অধিকিন্তু এলাকা ও দুশমন সম্বন্ধে যেন সঠিক খবর পাওয়া যায়। এইসব নতুন লোক ভর্তি ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের বদৌলতে ইতিমধ্যে সাব-সেক্টরে একটি সুসংগঠিত পদাতিক ব্যাটালিয়নে পরিণত হইল।

 সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ একবার জগদলহাট অধিকার করা হইল কিন্তু পাকসেনাদের গোলন্দাজ ও জীপে বসানো মেশিনগানের গোলাগুলিতে টিকিয়া থাকা মুশকিল হইল। তাহারা পাল্টা আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। ঐ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হইতে পাকিস্তানীরা রীতিমত ভড়কাইয়া গেল, কারণ, তখন হইতে হাতেকলমে সামরিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভের জন্য সদ্য ও স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২/৩ শত করিয়া আমাদের কাছে আসিতে লাগিল। তাহারা সপ্তাহ দুই-একের জন্য আসিত এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পর নিজ নিজ অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের জন্য চলিয়া যাইত। ইহাতে আমাদের সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার অনেক অসুবিধা হইত বটে কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে সুবিধও ছিল অনেক। আমাদের ক্লান্ত সৈন্যরা মাঝে মাঝে স্বস্তিতে বিশ্রাম করিতে পারিত।