পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
323

যায়। আমরা দেখছিলাম যে পাকিস্তানীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা তাদের উপর গুলি করছিলাম। এবং কলেজ বিল্ডিং-এ তাদের যা কিছু ছিল তাতে আমরা আগেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ইতিমধ্যে পেছন দিক থেকে লেঃ ফারুক যে রোডের উপর এ্যামবুশ করেছিল শত্রুরা সেই এ্যামবুশের উপর দিয়ে তাদেরকে ক্রস করে আমাদের পিছনের দিকে চলে আসে। সুতরাং আমাদের সামনেও পাকিস্তানীরা ছিল, পিছন দিকেও পাকিস্তানীরা ছিল। যদিও কর্নেল নওয়াজেশ আমাকে আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলেন কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া মানে আমার দলের অনেক লোক হতাহত হওয়া। কারণ আমার দলের লোকদের ভাল ট্রেনিং নেই। পাকিস্তানীরা মর্টার ছোড়া শুরু করেছিল। ওখানে থাকা মানে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া। এই জন্য আমি ওখান থেকে আমার লোকজন নিয়ে উইথড্র করে আবার ইণ্ডিয়াতে ফেরত চলে আসি। এই ব্যাপারটা নিয়ে কর্নেল নওয়াজেশের সাথে আমার বেশ গণ্ডগোল হয়, যার ফলে তখন আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন এম, কে, বাশার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আমাকে একটা আলাদা সাব-সেক্টর দেয়া হবে। সেটা হচ্ছে পাটগ্রাম। পাকিস্তান আর্মি তখনও পাটগ্রামে আসেনি।

 পাটগ্রাম এমন একটা জায়গা যেটা লম্বায় প্রায় ২২ মাইল, চওড়ায় দু'পাশে ইণ্ডিয়া, অনেকটা লাউয়ের মত। লাউয়ের গলাটা আড়াই মাইল। আড়াই মাইল জমি বাংলাদেশের, দু'পাশে ইণ্ডিয়া। মধ্যখান দিয়ে একটা রেলওয়ে লাইন চলে গেছে। এজন্যই হয়তো সেই এলাকায় পাকিস্তান আর্মি আসেনি বা আসতে সাহস করেনি। আমাকে বি-ডি-আর মুক্তিফৌজের একটা কোম্পানী দিয়ে বলা হলো যে পাটগ্রাম এলাকাকে যে কোভাবে মুক্ত রাখতে হবে। আমি ঐ এক কোম্পানী নিয়ে সোজা চলে যাই পাটগ্রাম এলাকাতে। এবং লাউয়ের গলার মাঝখানটা অর্থাৎ যেখানটায় সবচেয়ে কম জায়গা সেখানে একটা ডেফেন্স নেই এবং এক কোম্পানী দিয়ে পাটগ্রামের ডিফেন্সের আয়োজন করি। এটা খব সম্ভব আগস্টের শেষের দিকে হবে। পরে অবশ্য আমাকে পাটগ্রাম ডিফেন্সের জন্য ৫টা কোম্পানী দেয়া হয় ৫টা মুক্তিফৌজ কোম্পানী। বাওরা বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে আমরা ডিফেন্স নেই। ইতিমধ্যে, খুব মজার ব্যাপার, পাকিস্তানীরা হাতীবান্ধায় চলে এসেছে। হাতীবান্ধা ও বাওরার মধ্যে পার্থক্য তিন থেকে সাড়ে তিন মাইল। পাকিস্তানীরা হাতীবান্ধায় এসে ডিফেন্স নিয়েছে আর আমি বাওরায় একটা ডিফেন্স খুলেছি। তখন বর্ষাকাল ছিল বলে রেললাইনের উপর ছাড়া কোন যানবাহন চলতে পারতো না। আমি চিন্তা করলাম রেলাইনটা যদি কাট করা যায় তাহলে পাকিস্থানীরা আর আসতে পারবে না। আমার সাথে ৯০ জন লোক, হাতে কোন মেশিনগান ছিল না। কিন্তু আমি তখনকার ইপিআরদের দেখে বুঝতে পারছিলাম যে তাদের পক্ষে পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে সবসময় একজায়গা ধরে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্য আমি রেলওয়ে লাইনের আশে-পাশে যে সকল গ্রাম ছিল প্রত্যেক গ্রামে ডিফেন্স করে রেখেছিলাম। আমি ভাবছিলাম যদি পাকিস্তানীরা একটা গ্রামে আক্রমণ চালায় তাহলে তারা যেন সেই জায়গা ছেড়ে পরবর্তী গ্রামে গিয়ে বসতে পারে। পাকস্তানীরা সাধারণতঃ এক এক রাতে এক এক গ্রামে আক্রমণ চালাতো। আমাদের লোকেরা পরবর্তী গ্রামে গিয়ে ডিফেন্স নিতো। ডিফেন্স খোলা ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গায় এসে কিছুক্ষণ থাকার পরে ভোর হওয়ার আগেই তাদের মেইন ডিফেন্স হাতীবান্ধায় চলে যেতো। আমরা আবার সকালবেলায় আমাদের পুরনো জায়গায় গিয়ে বসতাম। এ রকম খেলা চলতে লাগলো প্রায় এক মাসের মত। পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল হাতীবান্ধায়। এভাবে আগষ্ট মাস পার হয়ে যায়। এর মধ্যে আমি আরেকটা কোম্পানী পাই। তখন রেললাইনের দু'পাশে দুটো কোম্পানী লাগিয়ে একটা পার্মানেণ্ট ডিফেন্স নিযুক্ত করি। পাকিস্তানীদেরও তখন শক্তি বেড়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমার ৫টা কোম্পানী গড়ে ওঠে। আমাদের উপর বার বার আক্রমণ হওয়ার ফলে আমাদের বেশ ক্যাজুয়েলটি হতো। ফলে আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার মনে করলেন যে জায়গাটা ধরে রাখতে হবে, জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তিনি আমাকে আরো ৫টা কোম্পানী পরে দেন। আমার পিছনে বি-এস-এফ-এর এটা ব্যাটালিয়ন ছিল, তার পরে ইণ্ডিয়ান আর্মির একটা ব্যাটালিয়ন ছিল। আমাদের সাপোর্টে তিনটা ট্যঙ্ক ছিল এবং ইণ্ডিয়ান আর্টিলারীর ব্যাটারী ছিল। আমাদের ডিফেন্স খুব শক্তিসম্পন্ন হয়ে গেছে। পাকিস্তানীদেরও আর্টিলারী ব্যাটারী ছিল। মোট কথা, ডিফেন্সিভ যুদ্ধ দুই পাশ থেকেই চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা ক্রমাগত আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। কেননা আমাদের সামনের