পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
325

চেষ্টা করতো কিন্তু আমাদের ডিফেন্স এত মজবুত ছিল যে তারা বারবারই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করতাম তাদেরকে পিছু হটাতে।

 একটি অপারেশনের কথা আমার মনে আছে। পাকিস্তানীদের ডিফেন্সের সামনে মাইনফিল্ড ছিল। আমাদের এ্যাটাকিং ফোর্স লেঃ ফারুকের কমাণ্ডে মাইন ফিল্ড অতিক্রম করে পাকসেনাদের বাঙ্কারের উপর চলে গিয়েছিল-কিন্তু আমাদের ছেলেরা যুদ্ধের সকল বিষয় ওয়াকিবহাল না হওয়ায় যথাযথ আক্রমণে ব্যর্থ হয় এবং মাইনে আমাদের বেশ হতাহত হয়।

 পাটগ্রাম থানা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশেই চলতো আমাদের প্রশাসন ছিল এবং আমরা পুরো থানা নিয়ন্ত্রণ করতাম। পাটগ্রামের পিছনে বুড়িগ্রামে আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। হেডকোয়ার্টারে আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার এম, কে, বাশার থাকতেন। তিনি দিনাজপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত কমাণ্ড করতেন। তাঁর সম্পর্কে দু'একটি কথা বলতে হয়। যদিও তিনি বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন তথাপি তিনি অতি সাফল্যের সঙ্গে আমাদের প্রায় ৩০০ মাইল সেক্টর এরিয়া দেখতেন। তাঁকে কোন সময় রাতে বিছানায় শুতে দেখিনি। জীপে জীপেই একটু-আদটু ঘুমাতেন। কারণ সারারাতই তাঁকে এক সাব-সেক্টর থেকে অন্য সাব- সেক্টরে ঘুরতে হতো। তাঁর প্রেরণা ছিল অফুরন্ত- আমাদের পাথেয়।

 আমাদের হাতীবান্ধা অপারেশন ছিল ভয়াবহ। হাতীবান্ধাতে পাকিস্তানীদের একটি কোম্পানী ছিল। আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার চেষ্টা করেছি- হাতীবান্ধা দাখল করতে ব্যর্থ হয়েছি। নভেম্বর ২০/২১ হবে। ঈদের দিন ছিল। আমরা ঈদের সুযোগ নিয়ে ঠিক সকাল ৮টায় হাতীবান্ধা আক্রমণ করি যদিও দিনের আলোতে ঐ সময় আক্রমণের উপযোগী ছিল না। আমরা অবশ্য ভেবেছিলাম ঈদের দিন পাকসেনারা হয়তো একটু রিলাক্স করবে এবং ঐ সময় অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকবে। আমরা চারটি কোম্পানী নিয়ে দুদিক থেকে আক্রমণ করি। আমাদের সৌভাগ্য ছিল বলতে হবে। কারণ পাকসেনাদের একটি কোম্পানী বদলী হচ্ছিলো এবং নতুন দল সে স্থান দখল করছিল, কিছু সৈন্য রওয়ানা হয়েছে, কিছু হচ্ছে- কিছু নতুন সৈন্য পজিশনে গেছে, ঠিক এমনি সময়ে আমরা আক্রমণ করে বসি। আমাদের প্রথম আক্রমণেই পাক অফিসার কোম্পানী কমাণ্ডার নিহত হয়। কমাণ্ডার নিহত হওয়ায় পাকসেনারা পিছু পালাতে থাকে। তারা প্রায় ১০০০ গজের মত পিছু হটে একটি গ্রামে পৌছে ডিফেন্স নেয়। সেখানে তাদের আর্টিলারী পজিশন ছিল। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নেই। এই আক্রমণে ভারতীয় আর্টিলারী অবশ্য খুব সাহায্য করে। পরবর্তীতে সকল আক্রমণেই ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারী প্রভূত সাহায্য করে। আমরা ক্রমশঃ আঘাত হেনে পাকিস্তানীদের পিছু হটিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। আমার সাব-সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ১০ই ডিসেম্বর লাঙ্গলেরহাটে পৌঁছাই। ইতিপূর্বে হাতীবান্ধা ছাড়া এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ আর হয়নি। পাকসেনারা লাঙ্গলহাটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে তিস্তার অপর পারে চলে যায়। আমরা ১৩ই ডিসেম্বর হারাগাছা এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করি। সেখানে কোন পাকসেনা ছিল না। হারাগাছার এই স্থান থেকে রংপুরের দূরত্ব ৮ মাইল হওয়া সত্ত্বেও রংপুর পৌছাতে আমাদের সময় লাগে তিনদিন। কারণ পথে অনেক জায়গায়ই পাকসেনা ছিল। রংপুর এলাকাতে পৌছাই ১৫ই ডিসেম্বর। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলেও রংপুরে পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। হিলির দিক থেকে আগত ভারতীয় সেনাবহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইতিমধ্যে কর্নেল নওয়াজেশের সাব-সেক্টর ট্রুপসও চলে আসে। আমাদের দুই সাব-সেক্টর ট্রুপস এক হয়ে গিয়েছিল। আমরা আমাদের ট্রুপস নিয়ে রংপুরে থাকি। ভারতীয় বাহিনী রংপুর সেনানিবাসে অবস্থান নেয়।

 প্রশ্নঃ সমগ্র যুদ্ধকালীন সময়ে আপনার এমন একজন সহকর্মীর কথা বলুন যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা দেখিয়েছেন।

 উত্তরঃ আমি ফারুকের কথা বলবো। ফারুককে লেফটেন্যাণ্ট বলা হলেও যে কারণেই হোক পাকিস্তানে সে কমিশন পায়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে সে আমার সাব-সেক্টরে যোগদার করে। সে সময়