পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
326

আমার সাব-সেক্টরে আমিই একমাত্র অফিসার ছিলাম। আর একজন অফিসারের অভাব আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করছিলাম। ফারুককে পেয়ে আমি ভীষণভাবে খুশী হই। বস্তুতঃ তাঁর মত সাহসী ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। হাতীবান্ধা আক্রমণের পর আমি একটি বি-ও-পি থেকে অয়ারলেসযোগে পাকিস্তানীদের উপর 'আঘাত হানার জন্যে আর্টিলারী ডাইরেক্ট করছিলাম। সেক্টর কমাণ্ডার বাশার আমার প্রায় ৬০০ গজ পিছনে ছিলেন। আমি আর ফারুক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আর্টিলারীর গোলা ছুড়ছিলো। গোলা যখন পড়ে তখন লক্ষ্যবস্তুর আশেপাশে পড়ার পরই লক্ষ্যবস্তুর উপর ফেলা হয়। আমাদের আশেপাশে গোলা পড়ছিলো এবং বুঝতে পারছিলাম এখনই আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে পড়বে। ফারুককে বললাম কভার নিতে কিন্তু সে কভার না নিয়ে আমার কাছে সরে আসে। পাকিস্তানী কামানের গোলা তখন ১৫/১৬ গজ দূরে এস পড়ে। সৌভাগ্যই বলতে হবে, ডিপ্রেসন থাকায় গোলা তেমন কাজে আসে না। আমি গ্রাউণ্ডে গেলাম। আমি উঠেই তার খোঁজ করলাম, দেখি সে হাসছে। আমি বললাম চলো কভারে যাই। সে বললো, স্যার এখানে আর শেল পড়বে না। আমরা দু'জন যেখানে গোলা পড়েছিল সেই গর্তে গিয়ে দাঁড়ালাম। তেমনি ছোট ছোট অনেক ঘটনার মধ্যদিয়েই লেঃ ফারুকের সাহসিকতার পরিচয় পেয়েছি।

 আমি সেক্টর কমাণ্ডারের কথা বলবো। তাঁর সকল অপারেশনে যাওয়ার কথা নয়- কিন্তু তিনি মেজর অপারেশনের প্রতিটিতেই স্বয়ং থাকতেন, তদারক করতেন। এতে ট্রুপস- এর মনোবল বৃদ্ধি পেত।

 আর একজন বি-ডি-আর হাবিলদার রাঙ্গু মিয়ার কথা বলবে। তার চেহারা দেখতে মনে হতো যেন সে একটা ডাকাত। হাতীবান্ধা অপারেশনে রাঙ্গু মিয়া (শহীদ) বীরবিক্রম এবং নায়েব সুবেদার সম্ভবতঃ লুৎফর (শহীদ) বীরবিক্রমের কথা না বললেই নয়। তখন বেলা সাড়ে আটটা। পাকিস্তানীদের ডানদিকের পজিশন ফল করছে। কিন্তু বামদিকের অবস্থান চিল একটি বি-ও-পিতে। বেশ উঁচুতে। আমাদের উচিত ছিল আগে বামদিকের পজিশন দখল করা। পরে ডানদিকের পজিশনে আঘাত হানা। আমার প্ল্যানিং-এ ভুল হওয়ায় আমি প্রথমে ডান ও পরে বামদিকে আক্রমণ চালাই। কিন্তু ডানদিকে আক্রমণ চালিয়েই আমি আমার ভুল বুঝতে পারি এবং বামদিকে দখল না করতে পারলে যে আমরা এখানে থাকতে পারবো না তাও বুঝতে পারলাম। দুটি কোম্পানীর একটির কমাণ্ডার ছিলেন বি-ডি-আর নায়েক সুবেদার লুৎফর আর তাঁরাই সঙ্গে ছিল হাবিলদার রাঙ্গু মিয়া। আমরা এ্যাটাকিং পজিশন থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে একটা বাঁশছাড় থেকে এগুচ্ছি বামদিকে। সময় তখন বেলা সাড়ে দশটা। আমরা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পাক আর্টিলারী গোলা (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়তে লাগলো। এই গোলা শূন্যেই ফাটে এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশী। এরই মধ্য দিয়ে এই দু'জন বিডিআর সৈনিক নির্ভয়ে পাকিস্তানীদের বাঙ্কার চার্জ করে এবং দখল করে। এদের সাহস ও আত্মত্যাগ তুলনাহীন। জাতির দুর্ভাগ্য, দু'জনই সংঘর্ষে পাকিস্তানী বাঙ্কার চার্জ করতে গিয়ে শহীদ হন।

 প্রায় বাইশ মাইল লম্বা এবং চওড়া ন্যূনতম ৩ মাইল, কোথাও ১৮ মাইল আমার সাব-সেক্টর মুক্ত ছিল। বলতে গেলে পুরো পাটগ্রাম থানাটাই আমরা মুক্ত রেখেছিলাম আমার সাব-সেক্টরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একবার আসেন। স্থানীয় এম পি মতিউর রহমান মাঝে মাঝে আসতেন অন্য আর কেউ তেমন আসতেন না। সি-ইন-সি কোনদিন আসেননি। বিদেশী সাংবাদিক আসেননি, তবে ভারতীয় সাংবাদিকরা আসতেন।

সাক্ষাৎকারঃ মেজর মোঃ আবদুস সালাম[১]

 জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ফুলবাড়িতে যে ক্যাম্প দেখে এসেছিলাম সেখানে যোগদান করি। শুরু থেকে আমার গেরিলা জীবনের শেষ পর্যন্ত এখানেই ছিলাম, অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এখান থেকেই


  1. সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ২২-১-১৯৮৯০ তারিখে গৃহীত।