বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
329

কিছু গ্রেনেড। প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারা বেরুলো রায়গঞ্জ দখলের। লেঃ সামাদের গ্রুপে ছিলো কমাণ্ডো মাহবুব, কাসেম ও অন্যরা এবং লেঃ আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিল ১৫জন শক্তিশালী কমাণ্ডো। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫- পাঞ্জাব রেজিমেণ্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। ঠিক হয় ৫০০ গজের মধ্যে গিয়ে অয়ারলেসে সামাদ ও আবদুল্লাহ দু'জনের পজিশন জানিয়ে দেবে। জাঙ্গল-শু পরে, চাদর গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাত ন'টায় নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে ৬নং সাবসেক্টর ভুরুঙ্গামারী থেকে ঈদের আগের রাতে। সোয়া ঘণ্টা যাত্রার পর রায়গঞ্জ ব্রীজের সন্নিকটে পৌছে লেঃ সামাদ সহসা দেখলেন তার গ্রুপের সবাই ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ট্র্যাপে পড়ে গেছেন। তিনি বুঝলেন ভুল রেকি হয়েছে। রায়গঞ্জ ব্রীজের নিচে ২৫ পাঞ্জাবের এল- -এম-জিসহ বাঙ্কার রয়েছে এ খবর তিনি পাননি। ছোট শিস-এর সংকেতে তিনি সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। অয়ারলেস সেট ওপেন করে 'হ্যালো আবদুল্লাহ' বলতেই শুরু হয়ে গেল ক্রস ফায়ারিং- সেই সাথে পাকিস্তানীরা তাদের ওপর আর্টিলারী গান ও ৩" ইঞ্চি মর্টার চালাতে লাগলো। বীর সামাদ বললেনঃ “কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না, মরলে সবাই মরবো, বাঁচলে একসাথেই বাঁচবো।” শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমৃত্যু পাঞ্জা লড়াই। অনেক শক্তিশালী ও দক্ষ এবং অনেকগুণ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ২৫-পাঞ্জাব বাহিনীর ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে বাংলার তরুন বীরেরা সেদিন ফুলের মত ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো। কিন্তু কেউ সামাদের আদেশ অমান্য করেনি। নিশ্চিত মৃত্যুমুখে থেকে, মুহুর্মুহু মর্টার শেল ও বুলেটের মুখে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এতটুকু দমেনি। নিজের শেষ বুলেটটি শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করেছে, তারপর নিজে শহীদ হয়েছে। আমাদের ১৫/২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন এক ব্যাটালিয়ন ২৫-পাঞ্জাবের বিরুদ্দে যে অসম সাহস ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করেছে পৃথিবীর যে কোন বীরত্বব্যঞ্জক লড়াই-এ সাথে তার তুলনা হতে পারে।

 অপরদিকে লেঃ আবদুল্লাহ হেডকোয়ার্টারকে ডেভলপমেণ্ট জানিয়ে দিল। ৬নং সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার বাশারের নেতৃত্বে মূল বাহিনী এগিয়ে এলো। ১৯ তারিখ ভোর থেকে ২০ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত কামান ও আর্টিলারী দিয়ে তিনি আঘাত হানলেন ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের উপর। গ্রাম থেকে লোক এসে বললো খান সেনারা ভেগে যাচ্ছে। ২১শে নভেম্বর সকালে সেই শক্তিশালী ট্ৰেইণ্ড ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট বিধ্বস্ত হয়ে রিট্রিট করলো ৫ মাইল দূরে নাগেশ্বরীতে।

 এই যুদ্ধে ২৫-পাঞ্জাবের কমপক্ষে সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচশ জন নিহত অথবা আহত হয়েছে। রণাঙ্গনেই পড়ে ছিল ৩০/৩৫ জনের মৃতদেহ। লেঃ সামাদের গ্রুপে মাহবুব ও কাশেম (অন্য রণাঙ্গনে তিনি পরে শহীদ হন) ফিরে আসতে পেরেছিল। এই যুদ্ধ ছিল আমাদের একটা বড় বিজয় এবং পাকিস্তানী ফোর্সের জন্য একটি আঘাত। কেননা ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট ছিল তাদের গর্ব। কিন্তু এই যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা হারিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বীর। এবং সেই যুদ্ধে প্রত্যেকেই বীরের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আমরা তাদের সবাইকে সালাম জানাই। সালাম জানাই সেই নির্ভীক যোদ্ধা লেঃ সামাদকে। ২১ তারিখ ভোরে রায়গঞ্জ ব্রীজের কাছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, প্যাণ্টের ভিতর হাফশার্ট ঢোকানো, মাটির উপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় লেঃ সামাদকে সবাই দেখলো- জীবনে যেমন সে বীরবিক্রমে লড়াই করেছে, মরণেও তেমনি বীরবিক্রমে মাতৃভূমিকে আলিঙ্গন করে শুয়ে রয়েছে। উইং কমাণ্ডার বাশার সামরিক কায়দায় ডান হাত কপালে তুলে সেল্যুট করলেন তাকে। সেল্যুট করলো সবাই। জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে তাকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু জানাজা পড়ার জন্য মৌলভী পাওয়া গেল না। সীমান্তের ওপার থেকে এক মসজিদের ইমামকে আনা হলো জানাজার জন্য। ৪১ বার গান সেল্যুটের সাথে সাথে রণাঙ্গনে বেজে উঠল লাস্ট পোস্ট। সব শহীদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করে সবাই চললো ফ্রণ্টের দিকে, হাতে ইস্পাতের চকচকে অস্ত্র, চোখে পানি। উইং কমাণ্ডার বাশার অন্যদের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। নিজে কাঁদছিলেন। ফ্রণ্টে ফ্রণ্টে বিজয় হয়েছে, সেই সাথে বেদনার সুর বেজেছে। অশ্রুজলে সবাই সিক্ত হয়েছে।